এসআইবিএল রেজাউলের টাকার পাহাড়
এস রহমান : সরকার উৎখাতে জড়িত ষড়যন্ত্রকারী-ফ্রিডম পার্টির নেতা এসআইবিএল সাবেক চেয়ারম্যান সাবেক মেজর (অব.) মোঃ রেজাউল হক টাকার পাহাড় বানিয়েছেন। একাজে তিনি নিজে যেমন ফুলে ফেঁপে উঠেছেন তেমনি স্ত্রীকেও রাজত্ব করতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাদের এই অবৈধ কর্মে সহায়তা করেছে সাবেক এমডি সহিদ হোসেন চক্র।এরা তাদের অপকর্ম ঢাকতে হাজার কোটি টাকা জঙ্গিদের সরবরাহ করে সরকার উৎখাতের নীল নক্সা রচনা করেছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দা তৎপরতায় তাদের সব জুয়াচুরি ফাঁস হয়ে যায়।এদের বিরুদ্ধে জাতিরকন্ঠের অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে শাপ বেরিয়ে আসছে।
গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার উৎখাতে জড়িত ষড়যন্ত্রকারী ফ্রিডম পার্টির নেতা এসআইবিএল (সোসাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড) এর সাবেক চেয়ারম্যান সাবেক মেজর (অব.) মোঃ রেজাউল হক এবং সাবেক এমডি সহিদ হোসেন চক্র হাজার কোটি টাকা জঙ্গিদের সরবরাহে জড়িত ছিলেন। এই দুই কুচক্রি সোসাল ইসলামী ব্যাংকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। খুব শিগগির তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) সীমাহীন অনিয়মের তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগের তদন্ত করবে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দীর্ঘদিনের অনিয়মসমূহ প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখছে। ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে তদন্ত হবে একটি বড় গ্রুপের অনুকূলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেওয়া ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েও।
দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকের পরিচালকরা তাদের খেয়াল খুশি মতো কাজ করেছেন। ব্যাংকটিতে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় এ ব্যাংকটিকে সতর্কও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়মের কারণে বর্তমানে ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা
পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। সূত্র জানায়, বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ অনেক পুরনো।
কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংকটির পর্ষদ চেয়ারম্যান (পদত্যাগী) মো. রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মো. আনিসুল হক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা শুধু জঙ্গি অর্থায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তারা ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছেন। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম অনুসরণ করেননি।
নিজেদের পছন্দের লোকদের ঋণ পাইয়ে দিতে নানাভাবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছেন। বিনিময়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। এসব অভিযোগের প্রতিটিরই পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে দুদক। ইতিমধ্যে দুদকের অনুসন্ধান টিমের কর্মকর্তারা ব্যাংকের আগের সব ধরনের নথিপত্রের কপি সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সিএসআর তহবিলের অর্থ প্রায় পুরোটাই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ব্যয় করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে দেশে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
ফলে ব্যাংকের লক্ষাধিক গ্রাহকের আমানত রক্ষার্থে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সব অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ব্যাংকটির সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান মো. রেজাউল হক ২০১৫ সালে ব্যাংকের অর্থে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকায় নতুন মডেলের একটি গাড়ি কেনেন। চলতি বছরই আবার ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের একটি নতুন মডেলের গাড়ি কেনেন।
শুধু তাই নয়, নিজের অনিয়মের সমর্থন পেতে ব্যাংকের তহবিল ভেঙে একাধিক পরিচালককে কোটি টাকা মূল্যের নতুন গাড়ি উপহারও দেন। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মবহির্ভূত কাজ হিসেবে চিহ্নিত। এমনকি তিনি প্রভাব খাটিয়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত একজন প্রভাবশালী অসৎ ব্যবসায়ীকে ব্যাংকটির পরিচালক মনোনয়ন দেন। বিতর্কিত ওই ব্যবসায়ী আবদুল আউয়ালের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের একাধিক মামলাও রয়েছে।
শুধু ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেই যে অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে তা নয় ব্যাংকটির বিভিন্ন সময়ের প্রকাশনা প্রকাশের মতো ছোট ছোট কাজেও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যাংকটির ২০১৬ সালের বার্ষিক রিপোর্ট ছাপানোর জন্য প্রতি পিস ৩৫৫ টাকা করে ৮০ হাজার বই এর বিল দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বাস্তবে ৫ হাজার বইও ছাপানো হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকার একটি বিতর্কিত বড় গ্রুপ অব কোম্পানিকে এসআইবিএল প্রিন্সিপাল শাখা থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৫০০ কোটির ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিশাল অঙ্কের এই ঋণের বিপরীতে কোনো মর্টগেজ নেওয়া হয়নি। অন্য পরিচালকরা এই ঋণ প্রস্তাবে সে সময় অসম্মতি দিলেও রেজাউল হক এবং তার অনুসারী পরিচালক মো. আনিসুল হকসহ অন্যরা প্রভাব খাটিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নেন। এই ঋণের রিকভারি এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ফলে এমন আরও কিছু ঋণ মিলিয়ে খেলাপি ঋণের বিরাট ঝুঁকিতে পড়তে পারে স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক।
এদিকে ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে ওই একই গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আরও ৭০ কোটি টাকা প্রেফারেন্স শেয়ার ক্রয় বাবদ ঋণ মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও কোনো ধরনের নিয়ম মানা হয়নি। এসব ঋণের পুরনো নথিপত্রের খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে দুদক।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে ব্যাংক থেকে ৮০ কোটি টাকা মুনাফাবিহীন ঋণ দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণভাবে আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের পরিপন্থী। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বিধিবহির্ভূত। তৎকালীন চেয়ারম্যান রেজাউল হকের স্ত্রী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফাউন্ডেশনের পরিচালক। রেজাউল হকের স্ত্রী হাসপাতালে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।
তার এসব অপকর্মেরও তদন্তে নেমেছে দুদক। সূত্র মতে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এতটাই অনিয়ম করা হয়েছে যে, কাগজপত্র কোনো যাচাই বাছাই না করেই বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আনোয়ার মির্জা নামের এক ব্যবসায়ীকে ফারহানা টেক্সটাইল মিলস ও নোয়াখালী ওয়েল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ৩২ দশমিক ৩০ একর সরকারি সম্পত্তি (যার আনুমানিক মূল্য ৬০২ কোটি ৯২ লাখ টাকা) দলিল মর্টগেজ দেখিয়ে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে।
এখানেও প্রভাব খাটিয়ে ওই ঋণ পর্ষদে অনুমোদন করিয়েছেন তৎকালীন চেয়ারম্যান রেজাউল হক। সম্প্রতি ৭৮ বছর বয়স্ক জনৈক গোলাম কবির নামক একজন দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন। টপটেন টেইলার্স নামক একটি সেলাইকারী প্রতিষ্ঠানকে বিনা জামানতে আশ্চর্যজনকভাবে ১৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন।
বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৮০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি থাকা সত্ত্বেও ধানমন্ডির আনোয়ারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে আবারও ১৬৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাবনায় অনুমোদন দিয়েছিলেন রেজাউল হক। অন্য একাধিক ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও পানামা টেক্সটাইল মিলসকে এসআইবিএলের ইস্কাটন শাখা প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
মারস টেক্সটাইলসকে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছিল। সেই ঋণের ১০৫ কোটি টাকা অনাদায়ী পড়ে আছে। মুস্তফা করপোরেশন নামের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের এক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের ১১৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে দীর্ঘদিন। যা এখন খেলাপি হিসেবে দেখানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
ডং ব্যাং ডাইং লি. নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এসআইবিএল গুলশান শাখার মাধ্যমে নিয়ম ভেঙে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ইচ্ছেমাফিক আমদানি এলসি খুলে মালামালগুলো রপ্তানি না করে তহবিল সরিয়ে নিয়েছে। মূলত, আমদানি-রপ্তানির নামে প্রতিষ্ঠানটি সেই অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।
যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আর এক্ষেত্রে বিদেশি এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করেছেন এসআইবিলকে। যার সবকিছুই জানতেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছেও এখন ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
এসব গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও অভিযোগ মাথায় নিয়ে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রেজাউল হক ও পরিচালক মো. আনিসুল হকসহ কয়েকজন। এসব অভিযোগের তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় অঙ্কের ঋণের নথিপত্র ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা শুরু করেছে সংস্থাগুলো।