এবার ইরান ইসরায়েল যুদ্ধের দামামা
” সবচেয়ে খারাপ একটি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইসরায়েল। দেশটির অভ্যন্তরে সামরিক স্থাপনায় শতাধিক ড্রোন এবং কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই হামলা হতে পারে।দুই মার্কিন কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজকে বলেছেন, স্থানীয় সময় শুক্রবারের মধ্যেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের একটি বড় হামলা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলার ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তেহরান।”
ইন্টারন্যাশনার ডেস্ক : এবার ইরান ইসরায়েল যুদ্ধের দামামা বাজছে। বলা হচ্ছে, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের মাটিতে ইরান হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এক কূটনীতিক এ তথ্য জানিয়েছেন বলে শুক্রবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ১৩ জন নিহত হন।
ইসরায়েল ওই হামলার দায় স্বীকার না করলেও তেল আবিবকেই দায়ী করেছে ইরান। ওই হামলার উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে বলেও তেহরানের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। আইআরজিসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মোহসেন রিজাইয়ের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে তাসনিম নিউজ। এ বিষয়ে পূর্ণ ধারণা রাখা যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, ‘ইসরায়েলের লক্ষ্য অন্যত্র থাকাকালে কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের মাটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে পারে ইরান। আমাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অন্তত তাই ইঙ্গিত করছে।ওই কূটনীতিক জানান, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই হামলা চালাতে পারে ইরান। এ হামলা মোকাবিলায় নিজেদের ভূখণ্ডের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টাইমস অফ ইসরায়েলের খবরে বলা হয়, হামলার বিষয়ে তেহরান এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেনি বলে জানিয়েছেন ইরানের এক কর্মকর্তা। আইআরজিসির এক উপদেষ্টার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সপ্তাহের শুরুতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে ইসরায়েলে হামলা চালাতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন আইআরজিসির কর্মকর্তারা। এর মধ্যে অত্যাধুনিক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথাও উল্লেখ করেন তারা।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা পোস্টগুলোতেও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে ইরানের হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের দিমোনার পারমাণবিক স্থাপনা, হাইফার বিমানবন্দরের মতো স্থাপনা, তবে এসব পোস্টের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি টাইমস অফ ইসরায়েল।সংবাদমাধ্যমটির খবরে উল্লেখ করা হয়, হামলার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মতো কিছু করা হলে অবশ্যই তার পাল্টা জবাব দেবে তেল আবিব। এ ক্ষেত্রে দেশটি ইরানের কৌশলগত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে।
প্রস্তুত ইসরায়েল :
ইসরায়েল ও ইরানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে বাগযুদ্ধ নতুন মাত্রা পায় বৃহস্পতিবার। ওই দিন ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘(ইরান থেকে) আগত সব ধরনের হামলা মোকাবিলায় আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’ এর পরপরই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে একাধিকবার তেহরানকে এমন কিছু না করতে সতর্ক করা হয়।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেসের (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যেকোনো হামলার জন্য পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করছে ইসরায়েল। আমরা প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।‘আমরা নিজেদের প্রতিরক্ষার পাশাপাশি পাল্টা আক্রমণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের যেসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তা দিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করা হবে। তা ছাড়া আমাদের কৌশলগত মিত্ররাও এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন।’
ইসরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের :
মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রল কমান্ডের জেনালের মাইকেল কুরিল্লা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলে পৌঁছান। সেখানে তিনি আইডিএফের চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেবির সঙ্গে নিরাপত্তাজনিত হুমকি ও তা মোকাবিলার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। ওই আলোচনার পরই আইডিএফের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে মিত্রদের কথা তুলে ধরে আইডিএফ।
ওই দিন রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়েভ গালান্ট। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের ওপর ইরান ও এর আঞ্চলিক মিত্রদের ক্রমবর্ধমান হুমকিতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সুদৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাবে।
‘ইরানি হামলা মোকাবিলায় মিস্টার গালান্ট যুক্তরাষ্ট্রকে গণনায় নিতে পারে। এ বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে’, উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। পরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘আমরা (লয়েড) অস্টিনকে জানিয়েছি যে, ইরান সরাসরি ইসরায়েলে হামলা করলে আমরাও তাদের একইভাবে জবাব দেব।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচনাকালে অস্টিন গালান্টের কাছে অভিযোগ করেন, ১ এপ্রিলের ঘটনার বিষয়ে আগে থেকে পেন্টাগনকে কিছুই জানানো হয়নি।
এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইরানকে বিরত রাখতে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান :
এদিকে ইসরায়েলে হামলায় নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে ইরানকে বোঝাতে বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে ওই ফোনালাপে মধ্যপ্রাচ্যে ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ পালন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছেন চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই।শুধু এ ফোনালাপ নয়, হামাসকে সহযোগিতা বন্ধের জন্য ইরানকে চাপ দিতে চীনকে প্রকাশ্যে বারবার অনুরোধ জানিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কূটনীতিকদের ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা :
ক্রমবর্ধমান হামলার হুমকি থাকায় এরই মধ্যে নিজ দেশের কূটনীতিকদের ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কবার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তেল আবিব, জেরুজালেম এবং বির শেভা এলাকার বাইরে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’
নাগরিকদের সতর্ক করেছে ফ্রান্সও :
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজ দেশের নাগরিকদের ইরান, লেবানন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি অঞ্চল ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্তেফান সেজোর্নের এক প্রতিনিধি শুক্রবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে বলে জানিয়েছে এএফপি।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ইরানভিত্তিক ফরাসি কূটনীতিকদের আত্মীয়রা ফ্রান্সে ফিরে আসবেন। একই সঙ্গে ফ্রান্সের বেসামরিক নাগরিকদের ইরান, লেবানন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি অঞ্চল ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে তেহরানের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করা হয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান এমন ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা (ইসরায়েলের হামলার) এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে যাতে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় কোনো অবস্থাতেই তাড়াহুড়া করা হবে না বলে ইরানের সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ইরান ‘খুব স্পষ্ট’ করে বলেছে যে, দামেস্কে দূতাবাসে হামলার জবাব তারা অবশ্যই দেবে। সে ক্ষেত্রে তা যেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়, তা নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য আঞ্চলিক মিত্রদের ব্যবহার করা হতে পারে বলেও ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এরই মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো বিশ্ব মোড়লরাও ইরানকে সংযত হতে অনুরোধ জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরান বলেছে, ইসরায়েলের হামলার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ব্যবস্থা নিলে প্রতিশোধের ‘আবশ্যকতা’ হয়তো এড়ানো যেত।এ বিষয়ে এক্সে দেয়া পোস্টে জাতিসংঘে ইরানের মিশন লিখেছে, ‘নিরাপত্তা পরিষদ যদি (দামেস্কের কূটনৈতিক চত্বরে) আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলকে বিচারের মুখোমুখি করত, তাহলে ইরানের আর এই দুর্বৃত্তকে শাস্তি দেয়ার কথা চিন্তা করা লাগত না।’