এত বড় স্পর্ধা মেয়ের, সিগারেট খায়! তার উপরে মেয়েটি হাফ প্যান্ট পরেছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতা কলকাতা : কলকাতাকে লন্ডনের মতো উন্নত করার প্রতিশ্রুতি ও প্রচেষ্টা মুখ্যমন্ত্রীর থাকতেই পারে। কিন্তু মানসিকতায় এই শহরবাসীর একাংশ যে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও কতটা পিছিয়ে, সেটা ফের বোঝা গেল বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় রাতে। যখন প্রকাশ্যে ধূমপান করার জন্য এক প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে রাস্তায় কটূক্তির শিকার হতে হয়, প্রতিবাদ করায় তাঁর পুরুষ বন্ধুকে প্রহৃত হতে হয় এবং ঠেকানোর চেষ্টা করলে শারীরিক নিগ্রহও করা হয় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ওই ছাত্রীকে।
ধূমপান যে শরীর ধ্বংস করে, সেটা নতুন করে প্রমাণ হওয়ার অপেক্ষা রাখে না। আবার প্রকাশ্যে ধূমপান ও গুটখা খাওয়া আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু সেটা অনেকেই মানেন না। ওই আইনভঙ্গের জন্য শাস্তি হওয়ার নজির প্রায় নেই বললেই চলে। আর প্রেসিডেন্সির ওই পড়ুয়াকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে ধূমপানের জন্য নয়, তিনি ‘মেয়ে’ হয়ে কেন ধূমপান করছেন, তার জন্য!
প্রকাশ্য রাস্তায় এক সাবালিকার ধূমপান করার উপরে স্বঘোষিত সামাজিক অভিভাবকদের হস্তক্ষেপের জের যে পর্যায়ে পৌঁছয়, তাতে ওই ছাত্রীকে নেতাজিনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করতে হয়েছে। পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করেছে এবং তাঁদের শনাক্ত করতে তরুণীর বর্ণনা শুনে ছবি বা ‘পোর্ট্রেট পার্লে’ আঁকানোরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিনি লিখিত জবানবন্দি দিতে চান, এই মর্মে ওই ছাত্রী পুলিশকে লিখিত অনুরোধও জানিয়েছেন।
পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে না বললেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ওই ছাত্রী দাবি করেছেন, শুক্রবার রাতে শাসক দল তৃণমূলের ছ’জন ক্যাডার তাঁদের উপরে হামলা চালায়। কিন্তু অভিযোগপত্রে হামলাকারীদের সে ক্ষেত্রে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ বলে উল্লেখ করলেন কেন? রবিবার ওই ছাত্রী আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘ওরা যে তৃণমূলেরই লোক, কী ভাবে প্রমাণ করব? আমরা যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, সেই সময়ে ওই জায়গায় তৃণমূলের একটি নির্বাচনী পথসভা চলছিল। যারা আমাদের উপরে চড়াও হয়, তারা ওই সভায় ছিল।’’
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে কমল গঙ্গোপাধ্যায় নামে নেতাজিনগরের এক বাসিন্দার নাম উঠে এসেছে। তাঁর পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে, কমলবাবু তৃণমূল সমর্থক। তাঁর বয়স সত্তর বছর। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে, তার কাছে টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সমর্থনে একটি সভা হচ্ছিল। সেখানে কমলবাবু ছিলেন। এ দিন কমলবাবুর মোবাইলে ফোন করে সেটি বন্ধ পাওয়া গিয়েছে। এসএমএস করলেও উত্তর মেলেনি। বাড়িতে গিয়েও তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি।
তবে তাঁর স্ত্রী মানসী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দু’টি অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে রাস্তায় অভব্য আচরণ করছিল। আমার স্বামী প্রতিবাদ করেছেন। গায়ে হাত তোলার কোনও ঘটনা ঘটেনি।’’ আর কমলবাবুর ছেলে শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হ্যাঁ, আমার বাবা একটি মেয়ের সিগারেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন। ঠিকই তো করেছেন। এর মধ্যে ভুল কিছু নেই। একটা মেয়ে রাস্তা দিয়ে ও ভাবে সিগারেট খেতে খেতে যাবে কেন? তার উপরে মেয়েটি হাফ প্যান্ট পরেছিল। বাবা বলায় মেয়েটি আর ওর বন্ধু মিলে তর্ক জুড়ে দেয়।’’ কমল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলের দাবি, ‘‘মারধর করা হয়েছে বলে আমি জানি না। এটা নিয়ে শুধু বচসা হয়েছিল।’’
ঘটনাস্থল যে বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে, সেই টালিগঞ্জের প্রার্থী অরূপ বিশ্বাস টলিউডের ‘নিয়ন্ত্রক’ বলে পরিচিত। টলিউডের কয়েক জন অভিনেত্রীও ধূমপান করেন। এ দিন অরূপ বলেছেন, ‘‘ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এক ব্যক্তি ও তাঁর ছেলে এক তরুণীর সিগারেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন। কিন্তু মদ, সিগারেট খাওয়া ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। যা-ই হোক, আমার দলের যোগ নেই।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণ শহরতলির নেতাজিনগর থানা এলাকার ৮৭ নম্বর পল্লিশ্রীর সামনে। ওই তল্লাট মূলত কলোনি। ওই তরুণী একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে করা পোস্টে জানাচ্ছেন, তাঁকে যখন কটূক্তি করা হয়, তখন তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, অদূরেই তো কয়েক জন পুরুষ ধূমপান করছে। কিন্তু তখন তাঁকে বলা হয়, এক জন মহিলার প্রকাশ্যে ধূমপান ‘সংস্কৃতি ধ্বংস করছে।’ তাঁকে শুনতে হয়, ‘এটা বম্বে নয়, এটা কলোনি, এখানে এগুলো আমাদের শিক্ষা নয়।’’
পুলিশের কাছে বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা ওই ছাত্রীর দায়ের করা অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি ও তাঁর এক পুরুষ বন্ধু শুক্রবার রাত ৯টা ১০ মিনিট নাগাদ নেতাজিনগর এলাকার ওই তল্লাট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর ধূমপান নিয়ে কটূক্তি করেন। সিগারেট ফেলে দিতে বলে হুমকি দেন। তখন ওই ছাত্রীর পুরুষ বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আরও কয়েক জন সেখানে জড়ো হন। যাঁরা ছাত্রী ও তাঁর বন্ধুর অনুমতি ছাড়াই তাঁদের ছবি তুলছিলেন। ছাত্রীর অভিযোগ মতো, ওই সব লোকজন প্রবল চেঁচামেচি শুরু করেন, তাঁদের ধাক্কাও দেন। সেই সময়ে এক জন ছাত্রীর ওই বন্ধুর গালে সজোরে থাপ্পড় মারেন।
ওই ছাত্রীর অভিযোগ, ‘‘আমার বন্ধুকে যখন মারা হচ্ছে, তখন আমি দু’পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠেকাতে যাই। সেই সময়ে আমাকে ধাক্কা দেওয়া হয়, গালিগালাজ করা হয়। হুমকি দিয়ে বলা হয়, ফের ওই কলোনিতে ঢুকলে পরিণতি খারাপ হবে।’’
তবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ওই ছাত্রীর অভিযোগ, পুলিশও তাঁকে হেনস্থা করেছে। কী ভাবে? ওই সাইটে তরুণী লিখেছেন, পুলিশ বারবার অভিযোগের বয়ান বদল করতে বলেছে। পুলিশ তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ায় প্রতিবেশীরা ভেবেছেন, তিনিই কোনও অপরাধ করেছেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছাত্রী আরও লিখেছেন, ‘‘রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ পুলিশ ফের আমার বাড়িতে আসে। অভিযোগের একটা ভুল সংশোধন করার জন্য। তার পরে ফের আমাকে থানায় ডাকা হয়।’’ ছাত্রীর মন্তব্য, ‘‘মনে হচ্ছে, অপরাধের অভিযোগ করতে গিয়ে আমি নিজেই কোনও অপরাধ করে ফেলেছি। বুঝতে পারছি না, কে বেশি বিপজ্জনক, পাড়ার গুন্ডা, নাকি থানার পুলিশ।’’
তদন্তকারীরা অবশ্য ছাত্রীর ওই অভিযোগ শুনে তাজ্জব। তাঁদের বক্তব্য, অভিযোগ পেয়েই যাদবপুর থানার পুলিশ ওই ছাত্রীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। যখন বোঝা যায়, ওটা নেতাজিনগর থানা এলাকায়, তখন সেই থানার পুলিশ তাঁকে নিয়ে সেখানে পৌঁছয়।
পুলিশের দাবি, ছাত্রীর লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যায় ভাবে বাধা দেওয়া, মারধর, হুমকি দেওয়া, মহিলাকে কটূক্তি করার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছে। এই সব প্রক্রিয়া শেষ হতে হতে রাত ১টা বেজে গিয়েছিল। তখন নেতাজিনগর থানায় কোনও মহিলা পুলিশ ছিলেন না। যাদবপুর থানা থেকে মহিলা পুলিশ এনে ওই ছাত্রীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়, তাঁর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই।
কিছু পরে ধরা পড়ে, অভিযোগপত্রে ওই ছাত্রী তারিখ ও সময় লেখেননি। তখন রাত ২টো বেজে গিয়েছে। থানা থেকে তাঁকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, এখন পুলিশ বাড়িতে গেলে তাঁর অসুবিধে আছে কি না। তিনি জানান, অসুবিধে নেই। তখন পুলিশ যায়। এ সব ক্ষেত্রে মহিলা পুলিশ নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তার পরে দেখা যায়, অভিযোগপত্র লেখা এবং তারিখ-সময় লেখার কালি আলাদা। ১৬ তারিখ দুপুরে তাঁকে থানায় ডেকে সেটা ঠিক করা হয়।
পুলিশের বক্তব্য, যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, সেই জন্যই এই সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তা হলে?
রবিবার আনন্দবাজারকে ওই ছাত্রী বলেন, ‘‘পুলিশি হেনস্থার অভিযোগ তো করিনি। পুলিশের ভূমিকার কথা শুধু বলেছি।’’