উত্তরার অবৈধ অস্ত্রের ডিলারের সন্ধানে গোয়েন্দারা!
প্রিয়া রহমান : রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র উত্তরায় বিপুল পরিমান অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় জনমনে ব্যাপক আতংক বিরাজ করছে।প্রশ্ন উঠেছে এত অবৈধ অস্ত্র আসছে কোথা থেকে? এসব অস্ত্রের ডিলারই বা কারা?
অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে। আগে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশী নামি-দামি ব্র্যান্ডের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহার সাধারণ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। গত ৮ বছরে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। এতে এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে সহজলভ্য। ফলে মাঝে-মধ্যেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়ছে পেশাদার সন্ত্রাসীরা। পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হচ্ছে বড় ধরনের অস্ত্রের চালানও।
এসব অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতংকিত। শনিবার উত্তরা থেকে থেকে বিদেশী অস্ত্রের বড় চালান উদ্ধারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবিরে দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। অস্ত্রের এ বিশাল মজুদ উদ্ধারের পর খোদ রাজধানীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কঠোর নজরদারির মধ্যে বিপুল পরিমাণ এ অস্ত্রের চালান ঢুকে পড়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও।
প্রশ্ন উঠেছে, এত অস্ত্র আসছে কোত্থেকে? গোয়েন্দারাই বা কি করছেন? বড় অস্ত্রের চালান উদ্ধারের ঘটনায় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ বছরেও দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কোনো বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়নি।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেয়ার পাশাপশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু গত জাতীয় নির্বাচন এবং একাধিক স্থানীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের কোনো অভিযান হয়নি। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জুন মাসে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালিত হয়। ওই অভিযানে সারা দেশ থেকে ৩ হাজার ৯৫টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় প্রায় ১০ হাজার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী। ২০০৮ সালের পর থেকে গত ৮ বছরে বিশেষ অভিযান পরিচালিত না হলেও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত (সাধারণ) অভিযান চালিয়ে ১৭ হাজার ৫৬৫টি অস্ত্র উদ্ধার করে। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো সাধারণত আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত অভিযানে প্রতিনিয়ত অস্ত্র উদ্ধার করছেন। সন্ত্রাসীরাও ধরা পড়ছে। তবে বিশেষ অভিযানের বিষয়ে খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেন।
পুলিশ সদর দফতরের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩০১টি অস্ত্র উদ্ধার হয়। ২০১৪ সালে অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩২৮টি। ২০১৩ সালে উদ্ধার হয় ১ হাজার ৭১৫টি। এছাড়া ২০১২ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০১১ সালে ২ হাজার ২৩৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। একইভাবে ২০১০ সালে ২ হাজার ৮১৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ২০৬ এবং ২০০৮ সালে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয় ৩ হাজার ৯৫টি।
বিপিডিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নজরদারি না থাকায় দেশের অন্তত দেড়শ’ অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট বিভিন্ন সীমান্তের অন্তত ৫৭টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান দেশে আনছে। পরে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। সগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতীয় অস্ত্রের পাশাপাশি চীন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার বন্ধে বিজিবির মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের জোরদার তৎপরতা হ্রাস পায়। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও বিজিবির কিছু অসৎ সদস্য চোরাকারবারিদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়। ফলে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে বাহকরা অবাধে সীমান্ত পার হয়ে দেশে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসিনতাকেও তারা দায়ী করছেন।
বিপিডিসির তথ্যমতে, দেশে যেসব অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে তার মধ্যে উগনি কোম্পানির রিভলবার, মাউজার পিস্তল, ইউএস তাউরাস পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল অন্যতম।
এছাড়া জার্মানির রুবি পিস্তল, ইউএস রিভলবার, আমেরিকার তৈরি পিস্তল, নাইন এমএম পিস্তল ও মেঘনাম কোম্পানির থ্রি টু বোরের রিভলবারও আসছে। অন্যদিকে স্প্যানিশ অস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগই আসে বঙ্গোপসাগরের অরক্ষিত উপকূল দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, চীন, ইসরাইল, জার্মানি ও রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্র আসে ভারত ও মিয়ানমার হয়ে।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে নিয়মিত অভিযানে উদ্ধার হওয়া অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই বিদেশী ও অত্যাধুনিক। দাম বেশি হওয়ার পরও হাতের নাগালে পাওয়ায় সন্ত্রাসীরা এখন অত্যাধুনিক অস্ত্রের দিকে ঝুঁকেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান বলেন, সীমান্তের চিহ্নিত অস্ত্র চোরাচালানের প্রবেশপথগুলো বন্ধ করতে না পারায় দেশে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বাড়ছে।
এছাড়া যেসব বিদেশী অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটিরই বিশেষ সিরিয়াল নম্বর আছে। সেসব নম্বরের সূত্র ধরেও অস্ত্রের কোম্পানি, কোম্পানি থেকে কেনা ডিলারের নাম-ঠিকানা, এমনকি খুচরা ক্রেতারও সব তথ্য জানা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, নামিদামি ব্র্যান্ডের অস্ত্র কোম্পানি থেকে বৈধ ডিলাররাই কিনতে পারেন। সেসব ডিলারের কাছ থেকে যারা অস্ত্র কেনেন, তাদেরও নাম-পরিচয়সহ বৈধ কাগজপত্র থাকে। এর ব্যতিক্রম যেখানে হয়, মূলত সেখান থেকেই অস্ত্র অবৈধভাবে চোরাকারবারিদের হাতে চলে যায়। এসব বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত হলে অস্ত্র চোরাকারবারিদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট শনাক্ত করা সম্ভব বলে তিনি জানান।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে তেমনভাবে গুরুত্ব না দেয়ায় অস্ত্র চোরাকারবারির বরাবরাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়।
বড় অস্ত্র চালান আটকের কয়েকটি ঘটনা : দেশে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালে। ওই বছরের ১ ফেব্র“য়রি ২ হাজার বিমানবিধ্বংসী গোলা, ২২ হাজার রাউন্ড ভারি মেশিনগানের গুলি, ১৭ হাজার এসএমজির গুলি ছাড়াও বিভিন্ন অস্ত্রের আরও ৪৩ হাজার গুলি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ৬০টি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক।
এর পরের বছর ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে (সিইউএফএল) উদ্ধার হয় দেশের সর্ববৃহৎ ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান। ট্রলার থেকে অস্ত্রের ওই চালানটি ট্রাকে তোলার সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করেন। এ ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের জোগসাজশ থাকার অভিযোগ ওঠে।
পরে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এসব অস্ত্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার গহিন বন থেকে উদ্ধার করা হয় অত্যাধুনিক একে-৪৭ রাইফেল ও ২০ হাজার রাউন্ড গুলি। একই বছরের ২১ এপ্রিল হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেট থেকে ১১৮ কার্টনে আনা বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। পরে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি বিশেষ বিমানে (টিআরইকে-২৭) ওই অস্ত্র বাংলাদেশে আনা হয়। তবে বিষয়টি আগেভাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে না জানানোয় তা কাস্টমস আটকে দেয়। পরে ওই অস্ত্রের চালান আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০১৪ সালের ৩ জুন হবিগঞ্জের দুর্গম পাহাড়ের বিভিন্ন বাংকার খুঁড়ে ২শ’ রকেট লাঞ্চারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব। পরে জানা যায়, উদ্ধার করা এসব অস্ত্রের মালিক ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ)। এরপরেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোটখাটো অস্ত্রের চালান উদ্ধার করেন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।