এটিএম কার্ড জালিয়াতি হয়েছে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ ও ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে
এস রহমান : তিন ব্যাংকের ছয় বুথে জালিয়াতি চক্র এটিএম কার্ড নকল করে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ ও ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে টাকা তুলে নিয়ে পালিয়েছে। এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারীরা।
রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডসহ তিনটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে এই জালিয়াতি হয়েছে। আজ সকালেও আমাদের তদন্ত দল সেসব ব্যাংক ও বুথ পরিদর্শন করেছে।
‘তদন্তের স্বার্থে’ অন্য দুটি ব্যাংকের নাম তিনি প্রকাশ করতে না চাইলেও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) কর্তৃপক্ষ একদিন আগেই তাদের বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসানোর অভিযোগ এনে বনানী থানায় মামলা করেছে।
ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ইলেকট্রনিক পেমেন্ট চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যেই এই জালিয়াতির ঘটনায় গ্রাহকদের মনে অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক ব্যাংকের বুথ থেকে আরেক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের টাকা তুলতেও সমস্যা হওয়ার অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা।
তবে শুভঙ্কর সাহা বলেন, ব্যাংকগুলোকে আগের মতোই সার্বক্ষণিক এটিএম বুথ ও অন্যান্য সুবিধা চালু রাখতে হবে। কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় বন্ধ করে রাখলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের নামে ৯০ লাখের বেশি কার্ড রয়েছে, যার মধ্যে ৮৫ লাখই ডেবিট কার্ড। দেশ জুড়ে প্রায় সাত হাজার এটিএম বুথের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সেবা দিচ্ছে। এছাড়া এসব কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটাও করা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচে (এনপিএস) যুক্ত এক ব্যাংকের গ্রাহক এই সুইচে থাকা অন্য ৪৭টি ব্যাংকের বুথ থেকেও টাকা তুলতে পারেন। এজন্য তাদের প্রতি লেনদেনের ১৫ টাকা করে গুণতে হয়।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার গ্রাহকের অজ্ঞাতসারে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলাসহ নানা ধরনের ‘ভুতুড়ে ট্রানজেকশনের’ ঘটনা ঘটার পর এই জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এই জালিয়াত চক্র ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) গ্রাহকদের কয়েক লাখ টাকা চুরি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যেভাবে জালিয়াতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জালিয়াতরা ছয়টি বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ ও ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছিল, যার মাধ্যমে তারা বুথে ঢোকানো কার্ডের তথ্য ও পিন নম্বর জেনে গেছে। এরপর ডুপ্লিকেট কার্ড তৈরি করে তারা টাকা তোলার কাজটি সেরেছে।
ইবিএল কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের গুলশান এলাকার দুটি বুথ থেকে এভাবে গ্রাহকের তথ্য চুরির প্রমাণ তারা পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগকারী গ্রাহকদের ২১টি কার্ড বন্ধ করা হলেও পরে ওই দুটি এটিএম বুথে ব্যবহার করা সব কার্ডই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।
মাইক্রোচিপের নিরাপত্তা নিয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা প্রযুক্তি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ফাইবার এট হোম এর চিফ স্ট্যাটিজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির জানান, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এভাবে টাকা চুরি করতে হলে প্রথমে কোনো একটি কার্ডের সমস্ত তথ্য নিতে হয়। এ জন্য দরকার হয় একটি স্ক্যানার, যাকে স্কিমিং ডিভাইস বলা হচ্ছে।
এটিএম মেশিনে কার্ড রিডারের কাছাকাছি কোথাও ক্ষুদ্র এই স্ক্যানার বসাতে হয়। কোনো কার্ড মেশিনে ঢোকানো হলে তার ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থেকে গ্রাহকের সমস্ত তথ্য ওই স্ক্যানার কপি করে ফেলে। পরে স্ক্যানার থেকে পাওয়া তথ্য একই ধরনের চিপ সম্বলিত আরেকটি ফাঁকা কার্ডে ভরে দিলেই তৈরি হয়ে যায় ক্লোন।
এই কার্ড দিয়ে টাকা তুলতে দরকার হয় গ্রাহকের পিন নম্বর। ওই পিন চুরির জন্য এটিএম মেশিনের কি বোর্ড, স্পিকার, দুই পাশ বা উপরের ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় বসানো হয় অতিক্ষুদ্র ক্যামেরা।
এ কারণে গ্রাহকদের পিন প্রবেশ করানোর সময় এক হাত দিয়ে অন্য হাত ঢেকে নেওয়া পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বুথে প্রবেশ করার পর কোনো কিছুতে সন্দেহ হলে কর্তৃপক্ষকে তা জানানোরও পরামর্শ দেন তারা।
জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ‘ব্যাংকের দায় চিহ্নিত করার বিষয়েও’ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের ডেটা জালিয়াতি হয়েছে, তার তালিকা তৈরি করে গ্রাহকদের জানাতে এবং পুরনো কার্ড বাতিল করে নতুন কার্ড দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।