এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের টাকা মেরেও গ্রেফতার না করে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৪ লুটেরাকে ছুটি
বিশেষ প্রতিনিধি : টাকা মেরেছে এবং তা প্রমাণিত’ও হয়েছে। তারপরও টাকা লুটের দায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় না নিয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও দুই ডিএমডিসহ চার কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোয় নানা প্রশ্ন উঠছে। জানা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের অর্থ মেরে দেয়ার অভিযোগে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরমান আর চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ নাদিমসহ চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অপর দুই কর্মকর্তা হলেন ব্যাংকটির ডিএমডি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মো. আব্দুল মবিন। আজ রোববার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। সিদ্ধান্তটি আজ থেকেই কার্যকর করা হয়েছে।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক মো. শাহীন উল ইসলাম, মো. আব্দুল ওয়াদুদ, এম আবু ইউসুফ ও মোহাম্মদ আশরাফুল হাসান।পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের অর্থ তছরুপ করার ঘটনা ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জড়িত ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি আরও অধিকতর তদন্তের জন্য জড়িত কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী পর্ষদ সভায় এমডিসহ দুই ডিএমডি ও ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।
এ নিয়ে জানতে ব্যাংকটির এমডিসহ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ফোন করা হলেও তাঁরা কেউ সাড়া দেননি। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে ব্যাংক থেকে প্রণোদনা বোনাসের নামে অতিরিক্ত টাকা নেন এমডি ফরমান আর চৌধুরী ও ডিএমডি মোহাম্মদ নাদিম। এরপর তাঁরা দুজন মিলে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা অবশ্য ব্যাংককে ফেরত দেন।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ব্যাংকটি বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর তাঁদের ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকটিতে নিরীক্ষা শুরু হয়। এরই মধ্যে ব্যাংকটির শীর্ষ দুই কর্মকর্তা টাকা ফেরত দেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলমের ভাই আবদুস সামাদ লাবুর ব্যক্তিগত সচিব মোহাম্মদ পিয়ারুর হিসাবে দেড় কোটি টাকা পাওয়া গেছে। তাঁকে প্রতিবছর পদোন্নতি দেওয়ার পাশাপাশি এক বছরে ৯ বার বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করেছে ব্যাংকটি।
এ ছাড়া ব্যাংকটির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) প্রায় ১০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবু। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে এই অর্থ তুলে নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে, ব্যাংকটির গুলশান শাখায় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নামে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ১০ কোটি টাকা লেনদেন শেষে হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফাউন্ডেশনের নামে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে পর্ষদের কোনো ধরনের কোনো অনুমতি ছিল না।
পরিদর্শনে এসেছে, এই হিসাবে ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৫ কোটি টাকা ও ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ৫ কোটি টাকা জমা করা হয়। এরপর ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর গাড়িচালক মো. রিপন ৩টি চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা তুলে দেন। ২৭ ডিসেম্বর এক কোটি টাকা উত্তোলন করেন আবদুস সামাদ লাবুর ব্যক্তিগত সচিব মোহাম্মদ পিয়ারু। ২ কোটি টাকা খাতুনগঞ্জ শাখার কর্মকর্তারা তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর অফিসে গিয়ে দিয়ে আসেন। বাকি টাকা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে উত্তোলন করেন চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ও পিএস।
এ নিয়ে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির পরিচালক এম আবু ইউসুফ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়েছে। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে এমডিসহ চার কর্মকর্তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।