একুশ-বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা-আমাদের অস্তিত্বে
হায়দার আকবর খান রনো : একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল মহান ভাষা আন্দোলনের একটি স্মরণীয় দিন হিসেবেই পালিত হয় না, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের মতো একই মর্যাদার ভিত্তিতে পালিত হয়ে আসছে।এখানেই একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল এবং শুরু হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর আমরা দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
অতএব ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা অর্জনের চরম দিনটিকে অথবা বিপ্লব সফল হওয়ার দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি কেন ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মতো একই ধরনের জাতীয় মর্যাদা নিয়ে পালিত হয়?
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বটে, যা তখনকার রাজনীতির ধারাকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরও বড় বড়, তীব্রতর আন্দোলন হয়েছে।
বড় বড় অভ্যুত্থানও হয়েছে। ইতিহাসের সেসব দিন আমরা শ্রদ্ধাভরে, গর্বভরে স্মরণ করলেও একমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি কেন বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে? একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনকে শুধু স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে নিছক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা পর্যায় মনে করলে ভুল বোঝা হবে। সামগ্রিকতায় একুশকে দেখা হবে না। শুধু ভাষার জন্য দাবিভিত্তিক আন্দোলন মনে করলেও খণ্ডিত করে দেখা হবে।
অবশ্যই এটা ছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ। অবশ্যই তা ছিল ভাষার জন্য সংগ্রাম। কিন্তু ভাষা এখানে এসেছে বাঙালি জাতীয় সত্তার প্রধান পরিচয় হিসেবে। ভাষা তো জাতীয় পরিচয়ের প্রধানতম দিক। একুশের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান-পরবর্তী যুগে প্রথম বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। আর তারই পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। একুশের মধ্যে আমরা বাঙালি সত্তাকে খুঁজে পাই।
দুনিয়াজোড়া ইতিহাসেও দেখা গেছে, ধর্মীয় অনুভূতি বা শ্রেণিচেতনার চেয়েও অনেক বেশি প্রবল ও আবেগ সৃষ্টিকারী হয়ে থাকে জাতীয় সাংস্কৃতিক অনুভূতি। একুশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য এখানেই।
একুশের চেতনা এতটাই প্রবল ও ব্যাপক যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলেও শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। একুশের মধ্যরাত বা ভোরে শহীদ মিনারের পুষ্পস্তবক দেওয়া একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে।
যখন কোনো ভাবাদর্শ বা চেতনা গোটা জাতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তার প্রকাশ রীতির রূপ ধারণ করতে পারে। একুশের আনুষ্ঠানিকতাকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা মনে করলে ভুল হবে। এর সঙ্গে আছে জড়িত আছে জাতীয় চেতনা—বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা।
পাকিস্তান আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতিসত্তাকে অস্বীকার করার ভাবাদর্শ।
জিন্নাহ সাহেব ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াশীল স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সব শ্রেণিই আশা করেছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে তারা লাভবান হবে।
কৃষক ভেবেছিল, সে হিন্দু জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্ত হবে। মধ্যবিত্ত আশা করেছিল, চাকরি ও ব্যবসায় হিন্দু প্রতিযোগী থাকবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এ জনগোষ্ঠী বাঙালি সত্তাকে পরিত্যাগ করতে রাজি ছিল। মুসলিম লীগ নেতারা এটা বুঝতে ভুল করেছিলেন। তাই জিন্নাহ অত সহজে বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন।
এমন ভুল বোঝার কিছু কারণও আছে। এই দেশের মুসলিম অভিজাত পরিবারে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করা হতো। তারা ঘরে উর্দুতে কথা বলত। জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ নেতারা সেটাই দেখেছেন এবং তাকেই একমাত্র সত্য মনে করেছেন। জনগণের মন বোঝার চেষ্টাও তাঁরা করেননি। মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব কিন্তু আরও আগে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলাদেশের দুই মুসলমান ব্যক্তিত্ব নবাব আবদুল লতিফ ও বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী মুসলমানদের ইংরেজি ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হলেও তাঁরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা মনে করতেন। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য তাঁরা দুজন যথাক্রমে ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ ও ‘ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল।
ফরিদপুরের খাস বাঙাল পরিবারে জন্মগ্রহণকারী আবদুল লতিফ পরবর্তী সময়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন, নবাব ও খানবাহাদুর পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজতেন ভারতবর্ষের বাইরে আরব, ইরান, তুরস্কের ইতিহাসের মধ্যে। একই সময়ে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদেরও উদ্ভব হয়েছিল।
একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ, অন্যদিকে হিন্দু, মুসলমান, কৃষক, সিপাহি, শ্রমজীবী জনগণের মিলিত সংগ্রাম—দুই পরস্পরবিরোধী ধারা পাশাপাশি চলেছে গোটা ব্রিটিশ জামানায়।
চল্লিশের দশকে সাময়িকভাবে তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদ জয়লাভ করলেও তা যে কত ভঙ্গুর ছিল, তা একুশের আন্দোলন দেখিয়ে দিল। বস্তুত একুশের আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই যে তা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিল, যদিও তখনই পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার মতো জায়গায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যায়নি। কিন্তু তেমন জায়গায় পৌঁছাতে বেশি সময়ও লাগেনি। মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল।
যাঁরা একদিন পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের সন্তানেরাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করছিলেন। চেতনার জগতে এই যে পরিবর্তন, তার সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।একুশের চেতনা এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে খণ্ডন করেই ভাস্বর হয়ে ওঠে।
একুশের চেতনা মানে হলো অবৈজ্ঞানিক ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।তবে এখানে যে কথাটা বিশেষভাবে বলা দরকার, তা হলো ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে পারিনি।
হিন্দুবিদ্বেষ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ ছিল পাকিস্তানি ভাবাদর্শের মূলকথা। সেটা এখনো মাঝেমধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। বর্তমানে তা উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের রূপ নিয়েছে। তারাই পয়লা বৈশাখকে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবরূপে না দেখে এর ভেতর হিন্দুয়ানির
চেহারা দেখে।
সে জন্য তারা পয়লা বৈশাখের সংগীতানুষ্ঠানে বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ মারে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে আওয়ামী ওলামা লীগও পয়লা বৈশাখের উৎসবকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দেয়। বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আড়ালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির মধ্যে মুসলমানি রং লাগাতে চায়।
তাই একুশের সংগ্রাম এখনো অব্যাহত আছে। তবে আশার কথা এই যে একুশের মধ্যে যে বাঙালি জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে, তা প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে এখনো বর্তমান রয়েছে। আমাদের অস্থিমজ্জায় ভাষায় ও সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসে যে চেতনা গাঢ় হয়ে মিশে আছে, তাকে ধ্বংস করা অত সহজ নয়। একুশের মিছিল, একুশের স্লোগান, একুশের গান সেই অপশক্তিকে বারবার রুখেছে, এখনো রুখবে।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।