• শনিবার , ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের নায়েবে আমির সুবহানের ফাঁসির আদেশ


প্রকাশিত: ৫:৫০ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৫ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৮১ বার

আসমা খন্দকার.ঢাকা: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের ফাঁসির আদেশ Jamat-Mawlana-Subhan-www.jatirkhantha.com.bd
দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ আজ বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু হয়। রায়ে বলা হয়, সুবহানের বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে এ সাজা দেওয়া হয়।রায়ের সংক্ষিপ্তসার থেকে জানা যায়, সুবহানের বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের মধ্যে ১, ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে সুবহানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁকে ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং ৩ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

প্রমাণ না হওয়ায় ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এ রায় ঘোষণা করেন।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর এই মামলায় দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি—কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নয়টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়।

Genocide-The-Tony-Mascarenhas-Articleপাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির সুবহান একাত্তরে দলটির কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাবনায় শান্তি কমিটি গঠিত হলে সুবহান প্রথমে ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সহসভাপতি হন। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুবহানকে আটক করে। ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

`আমি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বাবার সামনে মেয়েকে ও স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষিত এবং তাঁদের গুলি করে হত্যা করতে দেখেছি’

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ মঙ্গলবার জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী মো. আবু আসাদ (৬২)। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে সুবহান তাঁকে ধরে তাঁর ‘মুজাহিদ বাহিনীতে’ যোগদানে বাধ্য করান। তিনি বলেন, একাত্তরে সুবহান নিজে অনেককে গুলি করতেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আজ মঙ্গলবার আবু আসাদের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সুলতানা রেজিয়া। এ সময় আসামির কাঠগড়ায় ছিলেন সুবহান।

জবানবন্দিতে আবু আসাদ বলেন, ওই সময় তিনি খুব কাছ থেকে দেখেন, বিভিন্ন অভিযানে সুবহানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে একের পর এক হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছেন। ঘটনার বর্ণনা দিতে একপর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলেন।

আবু আসাদ বলেন, তাঁর বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল ২০-২২ বছর। একাত্তরের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও সুবহান তাঁদের গ্রাম জয়নগরে অভিযানে এসে গুলি করে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি সুবহানের হাতে ধরা পড়েন। গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর তাঁকেসহ আরও কয়েকজনকে ধরে ট্রাকে তুলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনিসহ আটককৃতদের তাঁদের সঙ্গে কাজ করে পাকিস্তানকে রক্ষার নির্দেশ দিয়ে সুবহান তাঁর ‘মুজাহিদ বাহিনীতে’ যোগ দিতে বলেন। যারা এ নির্দেশ মানবে না, তাদের গুলি করে পদ্মা নদীতে ফেলে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন সুবহান।

জবানবন্দিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিত। প্রশিক্ষণের সময় তাঁরা দেখতেন সুবহান সাদা গাড়িতে এসে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই ৫-৭ জন যুবককে হাত ও চোখ বেঁধে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে নিয়ে যেতেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মধ্যরাতে সুবহান মেজর জয়তুনের সঙ্গে পরামর্শ করে ওই যুবকদের নিয়ে ব্রিজের ওপরে আনতেন। এ সময় বাধ্য হয়ে তাঁরাই ওই যুবকদের ব্রিজের ওপর তুলে আনতে সহায়তা করতেন। পরে যুবকদের গুলি করে হত্যা করা হতো। কখনো সুবহান নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করতেন, কখনো পাকিস্তানি সেনারা গুলি করত।

রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী আবু আসাদ বলেন, ১৫-১৬ নভেম্বর তাঁদের দুই মুজাহিদ সদস্যকে তিনি রাইফেলসহ পালাতে সাহায্য করেন। এতে সেনারা তাঁকে সন্দেহ করে নির্যাতন করে। সুবহানও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং মারধর করেন। একপর্যায়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। একদিন তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সুবহান মুলাডুলির বেতবাড়িয়া এবং হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা আড়মবাড়িয়ায় অভিযানে যান। সুবহানের হাতে থাকা তালিকা অনুসারে সেনারা সেখানকার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় সামনে কাউকে পেলে তাঁদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। জবানবন্দির এ পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষী বলেন, ‘ওই অভিযানে আমি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বাবার সামনে মেয়েকে ও স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষিত এবং তাঁদের গুলি করে হত্যা করতে দেখেছি। সুবহান এ সময় সেনাদের সঙ্গেই থাকতেন।’

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আরও বলেন, একাত্তরের ২৮-২৯ নভেম্বর তাঁদের একটি দলকে রেলওয়ে কালভার্ট ব্রিজের পাহারায় রাখা হয়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিনি পালিয়ে ভারতে যান। সেখানে কয়েক দিন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফেরেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকার তাঁকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীতে চাকরি দেয়।

সুজানগরে গণহত্যা নেতৃত্ব দেন সুবহান

 জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল মঙ্গলবার সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ২৬তম সাক্ষী আনিসুর রহমান। মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার গ্রন্থাগারিক আনিসুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, একাত্তরে সুবহানের নেতৃত্বে পাবনার সুজানগর থানায় গণহত্যা হয়েছিল।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনিসুর এই মামলায় জব্দ তালিকার প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন।

জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে তিনি জবানবন্দিতে বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা জেলা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সুবহান। পরে অবশ্য আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়, সুবহান ওই কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে সুজানগর থানায় গণহত্যা হয়েছিল, যাতে সুবহান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আনিসুর রহমান জানান, গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনগুলো সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালে পর্যায়ক্রমে সংগ্রহ করা হয়। তিনি তদন্ত সংস্থার গ্রন্থাগারে এগুলো সংরক্ষণ করেছেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন এগুলো জব্দ করেন।
জবানবন্দি শেষে আনিসুরকে জেরা করে আসামিপক্ষ। সুবহান এ সময় আসামির কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়  জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী তহুরুল আলম মোল্লা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে তাঁর বাবাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন আবদুস সুবহান। পরে সুবহানের সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাঁর বাবাকে হত্যা করে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তহুরুল আলমের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সুলতান মাহ্মুদ। এ সময় আসামির কাঠগড়ায় সুবহান হাজির ছিলেন।
জবানবন্দিতে তহুরুল আলম (৬২) বলেন, তাঁর বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। একাত্তরের ২৬ মার্চের পর তাঁর মা ও ভাইবোনদের গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনিও গ্রামের দিকে চলে যান। তাঁর বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন, মামা ও ফুফাতো ভাই নিরাপদ ভেবে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। ১৭ এপ্রিল বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি বাবার খোঁজে ঈশ্বরদী যান। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রেললাইনের পাশে কয়লার ডিপোর কাছে জঙ্গলের মধ্যে লুকানো অবস্থায় দেখেন, আবদুস সুবহান, মতিউর রহমান নিজামী ও খোদাবক্স প্রমুখ তাঁর বাবাকে মসজিদ থেকে টানতে টানতে পাশের কয়লার ডিপোর কাছে নিয়ে যান। সুবহান একটি ছুরি নিয়ে তাঁর বাবাকে আঘাত করলে তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। পরে সুবহানের সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
তহুরুল আলম বলেন, ১৮ এপ্রিল তিনি বাবার লাশ আনার জন্য একই জায়গায় গিয়ে ফুফাতো ভাই মতলেব আহমেদ খান ও তাঁর ছেলে নাজমুল হক খানকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেন।জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে আসামির কাঠগড়ায় হাজির সুবহানকে শনাক্ত করেন সাক্ষী।