একটি ভ্যান এর আত্মকাহিনী- এবং তোলপাড় ফেসবুক
প্রিয়া রহমান : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গীপাড়ায় গিয়ে যার ভ্যানে চড়েছিলেন, সেই ভ্যানচালক ইমাম শেখকে বিমান বাহিনীতে চাকরি দেওয়া হচ্ছে -এমন খবর প্রকাশ হবার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে এই চাকরি দেবার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন, আবার অনেকে এর সমালোচনা করেছেন।
যেমন পাভেল শেখ নামে একজনের মন্তব্য “বাহ্ ,কয়েক মিনিট ভ্যান চালিয়েই বিমান বাহিনীতে !! আমাদের দেশে এমন হাজার পিতা আছে যাদের ভ্যানের প্যাডেল ঘোরা পরিশ্রমে তাদের ছেলেমেয়েরা অনার্স মাষ্টার্স পাশ করে বেকার বসে আছে ।।
যাদের একদিন প্যাডেল না ঘুরলে তাদের ছেলেমেয়েরা না খেয়ে পড়া লেখা করতো। আর এই ভ্যানওয়ালা কয়েকটি মিনিট ভ্যান চালিয়ে বিমানবাহিনীর মত চাকরি পায়। আমি ঐ ভ্যানচালকের চাকরির বিরোধিতা করছিনা ,আমি বিরোধিতা করছি এই প্রক্রিয়ার”।
মেহেদি হাসান লোভন নামে একজনের মন্তব্য “একটি ভ্যান এর আত্মকাহিনী … বিদ্র: বিমান এবং ভ্যান উভয়ই ত্রিচক্রযান”। তবে এমন উদ্যোগের সমালোচনার বিপক্ষে নুর আলম সিদ্দিকী নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন “একটা ছেলে পিওনের চাকরি পেয়েছে জেনে লোকজনের আচরণ দেখে অবাক না হয়ে বিরক্ত হচ্ছি”। “অপরের ভালো সহ্য করতে শিখুন” মন্তব্য আলম সুজনের।
তবে ভ্যানচালকের চাকরির খবরের সাথে তার ভ্যানটিকে জাদুঘরে রাখার খবরও প্রকাশ হয়েছে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে। এ খবরের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভ্যানচালক ইমাম শেখ ও তার মামা আব্দুল কাইয়ুম শেখ এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ‘ভ্যান’ নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।অনেকে একে ক্ষমতার অত্যাধিক প্রদর্শন হিসেবে উল্লেখ করছেন, আর অনেকের ভাষায় এটি একধরনের ‘তেলবাজি’ ঘটনা।
যেমন মাহমুদুল হাসান লিখেছেন “আমপাবলিকের হাতে রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কোন ক্ষমতা না থাকলেও একটা ক্ষমতা থাকে, সেটা হলো ভালবাসার ক্ষমতা। ভ্যানে চড়ে শেখ হাসিনা মানুষের যতটুকু ভালবাসা অর্জন করেছিলেন, ভ্যানওয়ালাকে বিমান বাহিনীতে চাকরি দেয়া এবং ভ্যানকে জাদুঘরে রাখার খবরে তার চেয়ে বেশি খোয়া দিলেন”। অন্যদিকে শরিফুল হাসানের মন্তব্য “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানে চলার ছবি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই বলে কি ওই ভ্যান জাদুঘরে পাঠাতে হবে?
ফেসবুকে কয়েকজনের মন্তব্য
“আমার নিজের ধারণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওই ভ্যানচালককে চাকুরি পর্যন্তই বলেছিলেন। ভ্যান জাদুঘরে পাঠাতে বলেননি। যাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এই ভাবনা এসেছে কিংবা যারা আগ বাড়িয়ে ভ্যানটাকে জাদুঘরে নেওয়ার ঘোষণা করছে তারা তেলবাজ। এদের কারণে ভালো কাজগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ হয়”।
ভ্যানচালক ইমাম শেখের কথা
গত ২৭শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গোপালগঞ্জে যান এবং একটি রিকশাভ্যানে চড়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে পৈতৃক বাড়ি ঘুরে দেখেন। ভ্যানে চড়ার সেই ছবি প্রকাশের পর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই শেয়ার করেন।
তবে এ ঘটনার দু’দিন পরই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় যে ভ্যানচালকের চাকরি হচ্ছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে।যে ইমাম শেখের ভ্যান ও চাকরি নিয়ে বিতর্ক চলছে, তিনি আজ যশোর থেকে তাঁর নিজের গ্রামে ফিরছেন। ভ্যানচালক ইমাম ও তার পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে চাকরি হচ্ছে সেটা জানলেও সেটা কী চাকরি আর কবে থেকে কাজ শুরু হবে, সে বিষয়ে তারা এখনও কিছু জানেন না।
ইমাম শেখ যশোরে বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করার পর আশ্বাস পেয়েছেন যে শীঘ্রই তিনি সেখানে কাজ করতে পারবেন।”তবে প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন চাকরি হবে, আশা করছি হয়ে যাবে,” বলছিলেন ইমামের মাম আব্দুল কাইয়ুম শেখ।
ইমাম শেখরা পাঁচ ভাইবোন। এর মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়েছে আর ছোট বোনটি স্কুলে পড়ে। তারা দুই ভাই-ই ভ্যান চালান। বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হবার পর থেকে ইমাম সংসারের হাল ধরার জন্য রিকশাভ্যান চালানো শুরু করেন। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন, সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশও করেন তিনি। যেই ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান ইমাম শেখ সেটিও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিস্তিতে কিনেছেন। ইমাম বলেন যে প্রধানমন্ত্রীকে ভ্যানে চড়িয়ে তিনি খুব আনন্দিত।
“সেদিন যখন একটা ভ্যান পছন্দ হলো না, আমারটাতে আপা চড়বেন বলে ঠিক হলো, পাশ থেকে একজন সিকিউরিটি অফিসারের মতো কেউ বলছিল তুমি ভাগ্যবান, প্রধানমন্ত্রী তোমার ভ্যানে চড়বেন”।প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বাড়িতে রাখার পর যখন ইমামকে টাকা দেয়া হয় তখন তিনি তা নেননি।
“আমি নিইনি কারণ আপাকে চড়াইছি। আমি আমার কষ্টের কথা বলতে চাইছিলাম কিন্তু পারি নাই। চলে আসছি” বলেন ভ্যানচালক ইমাম শেখ। পরে রাতে তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারেন যে তাকে চাকরি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন যশোরে। সেখানে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন ইমাম।তবে চাকরি শুরু না হওয়া পর্যন্ত ভ্যান চালিয়ে যাবেন ইমাম, তাঁর ভাষায় “ভ্যান না চালালে সংসারতো চলবে না ঠিকমতো”।