ইসি হবেন-সৎ যোগ্য চাপে মাথা নত করবেন না-বিশিষ্ঠজনদের মতামত
বিশেষ প্রতিনিধি : বিশিষ্ঠজনরা মতামত দিয়েছেন,এবার ইসি হবেন-সৎ যোগ্য চাপে মাথা নত করবেন না এমন ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্টজনদের প্রত্যাশা রাষ্ট্রপতি সুপারিশের বাইরে যাবেন না
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে চার বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে সার্চ কমিটির সদস্যদের এই মতবিনিময়ের পর ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “উনারা নাম দেবেন, আমরা আশা করব, উনারা যে নাম দেবেন, তার বাইরে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি যাবেন না। এটা আমাদের এক্সপেকটেশন… যদি যায়, তখন কী হবে? এটাওতো একটা প্রশ্ন। আমাদের সবার প্রত্যাশা হচ্ছে এই কমিটির সাকসেসফুল হবে, তাদের যে কটি নাম, তার বাইরে সরকার যাবে না।
সার্চ কমিটির আমন্ত্রণে সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ বেলা ১১টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনায় অংশ নেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির সবাই এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সার্চ কমিটির দ্বিতীয় দফায় এই মতবিনিময়ের পর মন্ত্রিপরিষদের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, “তারা পরামর্শ দিয়েছেন, এমন লোকদের নির্বাচন করতে যাদের ব্যপারে কোনো প্রশ্ন নেই, যাদের ক্লিন ইমেজ রয়েছে, সমাজের সবাই যাকে ভাল হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের প্রশাসনিক যোগ্যতা রয়েছে, কাজের দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা রয়েছে। এবং তারা যেন কোনো চাপের কাছে মাথানত না করেন। এমন ব্যক্তিদের সুপারিশ করার জন্য তারা পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া নাম থেকে ২০ জনের যে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার বিকালে আবার বসবেন সার্চ কমিটির সদস্যরা। যাচাই-বাছাই শেষে সার্চ কমিটি দশজনকে চূড়ান্ত করে ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের নাম সুপারিশ করবে। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যূন পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবেন।
মতবিনিময়ের পর সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা বলেন, আমরা চারজনই একমত যে নির্বাচন কমিশনে যারা নেতৃত্ব দেবেন, তাদের দল নিরপেক্ষ, বিবেকবান, প্রজ্ঞাবান, সাহসী ও পরিশ্রমী হওয়া উচিৎ। নির্বাচন কমিশনকে যদি আমরা কার্যকর ও স্বাধীন দেখতে চাই, আমাদের দরকার অত্যন্ত যোগ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সার্চ কমিটির কাছে এটিই আমাদের পরামর্শ।
এক প্রশ্নের জবাবে আবু হেনা বলেন, আবারও প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাব পেলে তিনি তাতে সাড়া দেবেন না।নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের মতামত গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত এবং এটিই কন্টিনিউ করা উচিৎ। ‘অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে’ সার্চ কমিটির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, আমি জোর দিয়ে বলেছি, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যার সামান্যতম বিরোধ আছে তাকে করা যাবে না। আর যেটা বলেছি, সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করে যে মতামত তারা নিয়েছেন… আমরা যে কথা বললাম, তা যেন পরবর্তী সময়ের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জাবাবে সমকাল সম্পাদক বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হচ্ছেন প্রতীক, তিনি যদি একটু নরম হন তাহলে কমিশন জিরো হয়ে যাবে। আমরা ভারতের দৃষ্টান্তের কথা বলেছি। সেখানে নির্বাচন কমিশন কারও কথা মানে না। আমরা মনে করেছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মেরুদণ্ড শক্ত থাকতে হবে। কোনো ধরনের হুমকি-ধামকির তিনি পরোয়া করবেন না এবং তার বয়স হতে হবে ৭০ এর নিচে।
নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আইন প্রণয়নের চেয়ে বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন এই সম্পাদক।তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে আমাদের কোনো আইন নাই। এখন পৃথিবী এগিয়ে গেছে। এখন নির্বাচনী ব্যপারগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কানাডাসহ পৃথিবীর ২০টি দেশে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত। আমি বলেছি, আইন নয় এটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এটি পরিবর্তন করা কঠিন হবে।
এর আগের নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় গঠিত সার্চ কমিটির কর্মপদ্ধতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে ইংরেজি দৈনিক ডেইলিস্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, যখন সার্চ কমিটি নাম দিয়েছিল, তখন কেবিনেট সচিব উনি কিন্তু পাবলিক করে দিয়েছিলেন, আমার মনে হয় ওইটাই যথেষ্ট। এবারও আমরা আশা করব, সার্চ কমিটির নাম পাওয়ার সঙ্গে গতবারের মতো এটাও পাবলিক করা হবে।
তিনি বলেন, উনাদের একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উনারা বিচক্ষণতার সঙ্গে সেগুলো দেবেন। উনারা পলিটিক্যাল পার্টির কাছে নাম চেয়েছেন, সিভিল সোসাইটি আমরা কোনো নাম দিইনি। উনাদের নামের ওপর বিতর্ক করা আমার মনে হয় সমীচীন হবে না।
ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার সৎ হবেন, যোগ্য হবেন, চাপে মাথা নত করবেন না- এসব বিষয় দেখেই সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনার বাছাই করবে। কিন্তু এগুলো প্রত্যেকটাই ব্যক্তিগত বিষয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর যদি তারা নিরাশ করেন তাহলে সে দায় সার্চ কমিটির ওপর বর্তায় না।একই কথা বলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদও।
যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী কাউকে বাছাই করে দায়িত্ব দেওয়ার পর তিনি যদি হতাশ করেন, সে জন্য সার্চ কিমিটিকে দোষারূপ করা যায় না। জনমনে প্রশ্ন থাকতে পারে যে সার্চ কমিটি গতবারও এরকম নির্বাচন কমিশনার বাছাই করেছিল, সেটাও আলোচনায় উঠে এসেছে।
বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে দায়িত্বে থাকা ইসির বিষয়েও কথা বলেন এই আইনজীবী।
এখানে মনে রাখতে হবে, ১৯৯৬ সালে আবু হেনা সাহেব একটি প্রসংশনীয় নির্বাচন করেছেন। পরবর্তীতে ২০০১ এ আবু সাঈদ সাহেব এবং ২০০৮ সালে শামসুল হুদা সাহেবও দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন করেছেন। কিন্তু আগামী নির্বাচনে যিনি প্রধান কমিশনার হবেন তাদের সঙ্গে বিগতদের একটা বিশাল তফাৎ আছে।
বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো নির্বাচন করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ওই সরকারগুলো নির্বাচন কমিশনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। নির্বাচন কমিশনার ছিলেন একেবারে চাপমুক্ত। আর আগামী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। ফলে এ নির্বাচন কমিশনের একটা চ্যালেঞ্জ থাকবে।এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, রাজনৈতিক সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। পূর্ণ আস্থা আছে সার্চ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিকেই নির্বাচন করবেন। আশা করছি সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচন হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবিত নাম থেকেই ইসি গঠন করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নামের বাইরে সার্চ কমিটিও কোনো নাম প্রস্তাব করতে পারে।
আগামীকাল বিকেল ৪টায় সার্চ কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। যেসব নাম সার্চ কমিটির কাছে এসেছে ওই নামগুলো পর্যালোচনা করবেন, যাচাই-বাছাই করবেন এবং খোঁজ-খবর নেবেন, তথ্য সংগ্রহ করবেন। আশা করছি ৮ ফেব্রুয়ারির আগেই চূড়ান্ত তালিকা করবে সার্চ কমিটি। আরেক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এখন পর্যন্ত আর কোনো বিশিষ্টজনের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সার্চ কমিটি যদি মনে করে, তাহলে তারা কাউকে ডাকতে পারে।