’ইসলামিক স্টেট’ ভয়ংকর জঙ্গিবাদ টার্গেটে ‘সার্ক’
: খবরটা হয়তো অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে। একাধিক ভারতীয় পত্রিকা জানিয়েছে, হায়দরাবাদ থেকে চার মুসলিম তরুণ এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ থাকার পর তাঁদের খোঁজ মিলেছে।
তাঁরা অভিভাবকদের অজ্ঞাতসারে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার লক্ষ্যে কলকাতায় মিলেছিলেন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ হয়ে ইরাকে সুন্নি জিহাদি গ্রুপ ইসলামিক স্টেটের চলতি যুদ্ধে শামিল হওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের আলাপচারিতার দিকে গোয়েন্দা পুলিশ বেশ কিছুদিন থেকে নজর রাখছিল, ফলে সন্ধান পেতে দেরি হলো না। তাঁদের পুলিশি তত্ত্বাবধানে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোনো অপরাধ করেননি, ফলে এই মুহূর্তে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাখিল করা হয়নি।
আদ-দাওলাহ্-ই-ইসলামিয়া নামের সংগঠনটি, যা পশ্চিমা তথ্যমাধ্যমে ইসলামিক স্টেট বা শুধু আইএস নামে পরিচিত, সেটি আল-কায়েদা ও তালেবানকে সরিয়ে এখন আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নিপ্রধান দেশগুলো আদ-দাওলাহ্কে রীতিমতো ভীতির চোখে দেখছে। হায়দরাবাদের ঘটনা থেকে স্পষ্ট, আদ-দাওলাহ্ আমাদের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু ভারত বা পাকিস্তান থেকে নয়, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও কয়েক শ মুসলমান তরুণ-তরুণী ইরাক ও সিরিয়ায় আদ-দাওলাহ্র পতাকাতলে সমবেত হয়েছেন। তাঁরা কারা, কিসের জন্য সম্ভাব্য বিপদ জেনেও যুদ্ধের ময়দানে জড়ো হচ্ছেন, তা খুব স্পষ্ট নয়।
যে কজন ব্রিটিশ তরুণ-তরুণীকে চিহ্নিত করা গেছে, তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণির, শিক্ষিত। ব্রিটিশ পুলিশ জানিয়েছে, ‘জিহাদ’-এ অংশ নেওয়ার অনুপ্রেরণা তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেয়েছেন স্থানীয় মসজিদভিত্তিক জিহাদি গ্রুপগুলোর কাছ থেকে। ইউরোপে বেকারত্ব বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বহিরাগতবিরোধী মনোভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলিম অভিবাসীরা এই মনোভাবের শিকার। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এসব অভিবাসী তরুণ-তরুণী কিছুটা বেপরোয়া হয়েই জিহাদে যোগ দিচ্ছেন। ভয় হচ্ছে, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ ময়দান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসব তরুণ-তরুণী যাঁর যাঁর দেশে ফিরে যাবেন, সঙ্গে নিয়ে যাবেন জিহাদি মন্ত্র।
এই ভয় কেবল ইউরোপের বা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব, মিসর ও তুরস্কেরও। আদ-দাওলাহ্ জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য মুসলিম বিশ্বজুড়ে একটি অভিন্ন খেলাফত গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে একজন খলিফার নামও তারা ঘোষণা করেছে। মুখ্যত ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আল-কায়েদা থেকে বেরিয়ে একটি অতি উগ্র জিহাদি গ্রুপের নেতৃত্বে আদ-দাওলাহ্ গড়ে উঠেছে। এরা এতই উগ্র যে আল-কায়েদা পর্যন্ত এদের নিজেদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার অতি দুর্বল, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিবাদে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই নিয়ে ব্যস্ত। ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, আদ-দাওলাহ্ তারই সুযোগ নিয়েছে।
প্রধানত সাদ্দাম হোসেনের সুন্নি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনী গত এক বছরে এই দুই দেশের ব্যাপক অঞ্চল নিজেদের দখলে এনে ফেলেছে। উভয় দেশের তেল সরবরাহের ওপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করায় তাদের কাঁচা টাকার কোনো অভাব নেই। অস্ত্রেরও কোনো কমতি নেই। কিন্তু শুধু ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে এরা খুশি হবে না। এদের আসল লক্ষ্য সৌদি আরব। সুন্নি মুসলমানদের নেতা, ধনে-মানে সবার ওপরে সৌদি আরব। সে দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জিত হলে একটি প্যান-ইসলামিক খেলাফত গঠন অনেক সহজ হয়ে যায়। এই লক্ষ্যে আদ-দাওলাহ্ তাদের ‘কাদেমুন’ অভিযান শুরুর কথা ঘোষণা করেছে। সে কথার অর্থ, আমরা আসছি।
আরব বিশ্বে সবচেয়ে বড় ও শক্তিধর দেশ মিসর। ইসলামিক ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে সেখানে একটি অতি কট্টর জিহাদি আন্দোলন অনেক আগে থেকেই তৎপর। হোসনি মোবারকের আধা সামরিক সরকার পতনের পর দুই বছর আগে মিসরে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আবরণে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে সরিয়ে সেখানে এখন সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু ব্রাদারহুডের বিপদ দূর হয়ে যায়নি। সেই কারণে আদ-দাওলাহর হুমকি মিসরেও কম্পন সৃষ্টি করেছে।
শিয়াপ্রধান ইরান এই মুহূর্তে আদ-দাওলাহর লক্ষ্য নয়, কিন্তু ইরানের কাছে বন্ধু ইরাকের ওপর তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন ভীতির কারণ হয়ে পড়েছে। ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে নিকট আঁতাত দীর্ঘদিনের, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের একমাত্র বন্ধু ইরান। এই মুহূর্তে আদ-দাওলাহর প্রধান টার্গেট সিরিয়া, এই ব্যর্থ রাষ্ট্রটির কোনো কোনো প্রদেশে তারা ইসলামি বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। পশ্চিমা তথ্যমাধ্যমের দেওয়া সংবাদ যদি সত্য হয় তবে তো এসব প্রদেশের বেসামরিক শাসনভার পরিচালনায় ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা তরুণ-তরুণীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
যেসব ইউরোপীয় তরুণ এই জিহাদে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ বাংলাদেশের, অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। পুলিশি সূত্রে বলা হয়েছে, ‘ব্রিটেনি ব্রিগেড বাংলাদেশি ব্যাড বয়েস’ নামে একটি জিহাদি গ্রুপ আদ-দাওলাহ্র জিহাদে অংশ নিতে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া ও ইরাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে হামিদুর রহমান নামের বাংলাদেশি এক তরুণ সিরিয়ায় যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সময় নিহত হন। ব্রিটিশ পুলিশ এই গ্রুপের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে আদ-দাওলাহ্র আবেদন উপমহাদেশের তরুণদের কাছে গিয়েও পৌঁছেছে। কেন, কোন সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে এসব আপাতশিক্ষিত ও শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণী জিহাদের ডাকে সাড়া দেন, আমরা এখানে তার সমাজতাত্ত্বিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাব না। কিন্তু তাঁরা যে সাড়া দেন, সে প্রমাণ আমাদের আছে। ঢাকার একাধিক ইংরেজি মাধ্যম কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মৌলবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ, সে কথাও আমরা জানি। তাঁদেরই একজন বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসে বোমাবাজির অভিযোগে এখন কারাগারে।
ভয়টা সেখানেই। ইরাক ও সিরিয়া ও অন্য সুন্নি আরব দেশগুলোর মতো আমাদের দেশও যে আদ-দাওলাহ্র প্রস্তাবিত খেলাফতি আন্দোলনে আক্রান্ত হতে পারে, সে কথায় কোনো ভুল নেই। এই আন্দোলনের একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আবেদন রয়েছে, হয়তো সেই আবেদন তরুণদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু বিশ্বের প্রতিটি জিহাদি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এর প্রথম ও প্রধান শিকার যার যার নিজের দেশের মানুষ। একাত্তরে এই জিহাদিদের প্রথম প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশের সেরা সন্তানেরা নিহত হন, অগুনতি নারী ধর্ষিত হন। এদের ব্যাপারে ভীতি কোথায়, আজকের পাকিস্তান, সোমালিয়া অথবা নাইজেরিয়ার দিকে তাকালেই সে কথা বোঝা যায়। শুদ্ধ ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠার নামে আদ-দাওলাহ্ দেড় হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
অতি নিষ্ঠুর এই আন্দোলন তাদের লক্ষ্য অর্জনে যে কী পরিমাণ অমানবিক হতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকে ভিডিও ক্যামেরার সামনে দুজন মার্কিন সাংবাদিককে গলা কেটে হত্যার ঘটনা তার প্রমাণ রেখেছে। নাইজেরিয়ায় আরেক খেলাফতি নেতার অনুসারীরা বন্দুকের ডগায় শ-তিনেক নাবালিকা স্কুলছাত্রী অপহরণ করেছে, তাদের অধিকাংশই এখন পর্যন্ত নিখোঁজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি আদ-দাওলাহ্র বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত অভিযানের কথা ঘোষণা করেছেন। শুধু সৌদি আরব নয়, তুরস্ক ও মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ সে অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অনেকেই ওবামার এই নয়া রণকৌশলে জর্জ বুশের ইরাক অভিযানের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। এই দুইয়ে মিল যে নেই তা নয়, কিন্তু একটা বড় ধরনের প্রভেদও রয়েছে।
ওবামা গোড়াতেই বলে রেখেছেন, ইসলামিক স্টেট ঠেকাতে তিনি মার্কিন পদাতিক সেনা পাঠাবেন না। ইরান বা সিরিয়া দখল তাঁর লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য আদ-দাওলাহ্ ঠেকানো, সম্ভব হলে তা নিশ্চিহ্ন করা। নতুন সর্বদলীয় ইরাক সরকারের সেনাবাহিনী ও সিরিয়ার আসাদবিরোধী বাহিনীকে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এমনকি প্রকারান্তরে ইরানও তাতে যুক্ত হবে। সৌদি আরব ও জর্ডানের বিমানবহর ইতিমধ্যেই বিমান হামলায় অংশ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোও এই অভিযানে সমর্থন দিয়েছে। সম্ভবত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনও মিলবে।
আদ-দাওলাহ্বিরোধী এই কোয়ালিশনে উপমহাদেশের দেশগুলোর কী ভূমিকা হবে, তারা কেউ এখনো খোলাসা করে বলেনি। আদ-দাওলাহ্র প্রধান, খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদি দুই মাস আগে ভারতের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা করেছিলেন, ইসলামের শত্রুকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাকে হত্যা করা হবে। এ কথার অর্থ ভারত অথবা বাংলাদেশ তার আক্রমণের বাইরে নয়। হায়দরাবাদের তরুণদের তৎপরতা থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশকে ‘ট্রানজিট’ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা নয়া জিহাদিরা করবে। এর আগে, আফগানযুদ্ধে পরাজয়ের পর বিদেশি তালেবানদের অনেকেই অন্যত্র যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।সমস্যাটি আন্তর্জাতিক, তার সমাধানও আন্তর্জাতিক পথে অর্জন করতে হবে।
উপমহাদেশে আদ-দাওলাহ্র তিন প্রধান টার্গেট—পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশকে একে অন্যের সঙ্গে সলা–পরামর্শের মাধ্যমে সমন্বিত রণকৌশল গ্রহণ তাই জরুরি হয়ে পড়েছে।
ওবামা যে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন গড়ার চেষ্টা করছেন, তার সঙ্গেই বা আমাদের সম্পর্ক কী হবে, সে প্রশ্নেও সমন্বিত সিদ্ধান্ত আখেরে সুফলদায়ক হবে।যা-ই করি, হাত গুটিয়ে থাকার আর সময় নেই। হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷