আমনের বাম্পার ফলন-উৎসব
বিশেষ প্রতিনিধি : আমনের বাম্পার ফলন-উৎসব চলছে উত্তরাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলে এবার আমন ধানের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছে কৃষকরা। সব কিছু কাটিয়ে এখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলারে ভাই’ গানের কথার মতো দৃশ্যমান প্রেক্ষাপট ফুটে ওঠেছে। তাই ‘কাঁচা শীতের পাকাধান ভরিয়ে দিয়েছে কৃষকদের অন্তর’। বর্তমানে গ্রামবাংলায় মাঠজুড়ে কৃষকের ফলানো সোনারঙ ধানের ছড়াছড়ি। আমন ধানের চনমনে গন্ধে মাতোয়ারা কৃষক। দিগন্তজোড়া মাঠ সেজেছে যেন হলুদ-সবুজ রঙে। ঘাম ঝরানো স্বপ্নের ফসল ঘরে তুলে আনতে কৃষক এখন প্রস্তুত। ভেসে বেড়াচ্ছে ম ম গন্ধ।
সেই সঙ্গে গ্রামগুলো হয়ে উঠছে স্বর্ণভান্ডার আর শস্যভান্ডার। কৃষকের মুখে দেখা দিচ্ছে অনাবিল সুখের হাসি। বাস্তবতায় দেখা মেলে পাকা ধানের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা শিশির। শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা বয়ে চলেছে। শিশির সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা সৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎনা ছড়ানো আলোকিত রাত প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। প্রকৃতির রূপে বাংলার মানুষের জীবনে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে ধান কাটার ধুম। যাকে আমরা বলে থাকি ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব।
বাংলাদেশের ১৪ টি কৃষি অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম রংপুর অঞ্চল। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আত্রাই বিধৌত প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ধারক-বাহক রংপুর অঞ্চল বর্তমানে উদ্বৃত্ত খাদ্যের ভান্ডার। পাঁচটি জেলা নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট। ৫ জেলায় রয়েছে পঁয়ত্রিশটি উপজেলা।চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলে আমন ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৭ হেক্টরে। বন্যায় ক্ষতি হয় ৯৮ হাজার ৩৪ হেক্টর জমির রোপিত চারা। সেখানে পুনরায় রোপণ করা ধান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ২১ হাজার ৫৭৪ হেক্টরে। অর্জিত হয় ৬৪ হাজার ৩৯ হেক্টর বেশি- যা ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৩ হেক্টর। সূত্র মতে, গত বছরের চেয়ে এবার ৭ হাজার ৮৪৩ হেক্টর জমিতে বেশি আমন ধান আবাদ হয়েছে। সূত্রমতে, কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহেই এই অঞ্চলে আগাম আমন ধান কর্তন করা হয় ৪৬ হাজার ১২১ হেক্টরে। সাধারণভাবে আমন ধান কর্তনের সময় অগ্রহায়ণ মাস। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে কার্তিক মাসের চলমান শেষ সপ্তাহেই সাধারণভাবে আমন ধান কর্তন শুরু হয়ে গেছে। ৫ নবেম্বর পর্যন্ত ৫৬ হাজার হেক্টর জমির ধান কর্তন করেছে কৃষক- যা দিনে দিনে আরও বৃদ্ধি পাবে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকদের ঘরে আমন ধান উঠতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও কৃষক বধূরা নতুন ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। অপরদিকে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ঘরে ধান, গোলায় ধান, আঙ্গিনায় ধান, জমিতে ধান, সড়কে শুকাতে দেয়া ধান। এলাকার প্রতিটি কৃষকের ঘরে-বাইরে এখন শুধু ধান আর ধান। এবারে এত ধান ফলেছে যা কৃষকের চিন্তার চেয়েও বেশি।
বিগত সময়ের দিকে ফিরে তাকালে এই সময়টা মনে করিয়ে দেয় অভাব মঙ্গার কথা। রংপুর কৃষি অঞ্চলের গ্রামীণ একটি বচন আছে- ঠেলা যায় হাত্তিকে, ঠেলা যায় না কার্তিককে। কৃষকের ঘরে এই সময় ফসলের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় নানান অভাব, একটি হাতি ঠেলে নেয়া কঠিন হলেও আরও ভয়াবহ অভাবের মাস কার্তিক মাসকে মোকাবেলা করা। দশ বছর আগের অভাব বা মঙ্গা বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর ফসলের বহুমুখীকরণ সেই মঙ্গা নামক দানবকে আজ জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
জীবের মাঝে মাঝে দেখা মেলে চঞ্চলতা, কলকাকলিতে মুখরিত আজ আকাশ-বাতাস-প্রান্তর। আমন উৎপাদনে কৃষকদের যে শঙ্কা ছিল সেটি কেটে গেছে। সকালের সোনারঙা রোদ বাড়িয়ে দেয় বাংলার পথঘাট আর মাঠের উজ্জ্বলতা, গ্রামের মাঠে যতদূর চোখ যায় সোনালি ধান। লাউয়ের মাচায় যৌবনবতী তরুণীর মতো লিকলিকে প্রতিটি ডগার খিলখিল হাসি, অতিথি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
কুয়াশার ধূসর চাদর গায়ে কমনীয় শীত। জুঁই, গোলাপ, শাপলা, বাগানবিলাস সহ অনেক ফুলের ভেতর দিয়ে প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। এ সময়ের নির্মল বাতাস প্রকৃতিকে আকর্ষণীয় করে তুলছে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। শহরে অতটা টের পাওয়া না গেলেও, গ্রামে খুব চোখে পড়ে প্রকৃতির এ বদলে যাওয়া।রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শাহ আলম বলেন, চলতি বছর আমনের ফলন গত বছরকেও ছাড়িয়ে যাবে। বন্যায় আমন লাগাতে কিছুটা সমস্যা হলেও বন্যা-পরবর্তী পলি মাটির উর্বরতায় বাম্পার ফলন হয়েছে। কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে এ অঞ্চলে আগাম আমন কাটা শেষ হয়েছে। এবার সাধারণ আমন ধান কর্তন শুরু হয়ে গেছে।