‘আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে তা বাতিল করেছেন তা যুক্তিযুক্ত না’
স্টাফ রিপোর্টার : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ রায় গ্রহণযোগ্য না, কিন্তু আমরা এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শ্রদ্ধেয় আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে তা বাতিল করেছেন তা যুক্তিযুক্ত না। কোনও সংশোধনী দ্বারা কারও বিরুদ্ধে কিছু করার অভিপ্রায় ছিল না এই সংসদের। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিচার বিভাগ ও সংসদ কোনও পাওয়ার কনটেস্টে নামেনি। বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সচিবালয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘আমাদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণকে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অপসারণ করাটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যর্থতা বলে মনে হয়েছে। আমরা মনে করেছি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি অত্যন্ত অসচ্ছল ও নাজুক। তাই এর পরিবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের স্বাধীনতা ও তাদের চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করা হয়েছিল বলেও আমাদের বিশ্বাস।’
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারের অবস্থান জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এখানে মন্ত্রী আরও বললেন, আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই, মাননীয় প্রধান বিচারপতি মামলার ফ্যাক্ট ইন ইস্যুর বাইরে গিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী বলে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করায় আমার মনে হয় মাননীয় বিচারপতির যে রায় তা যুক্তিতাড়িত নয়। বরং আবেগ ও বিদ্বেষ তাড়িত।
লিখিত বক্তব্যে আনিসুল হক বলেন, ‘আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা সংসদ বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনও পাওয়ার কনটেস্টে অবতীর্ণ হয়নি। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টাই করেছে।’
আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘সফল গণতন্ত্রে যেসব নীতি অনুসরণ করা হয়, সেগুলোকে যদি উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় তাহলে পরে যুক্তি আরও শক্ত হয়। অন্যদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে কনসেপ্ট তা শুধু মিলিটারি ডিক্টেটরদের বই থেকেই প্রাপ্ত। উদাহরণ, ১৯৬২ সালের আইয়ুব খানের সংবিধান। তাই এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খায় না।’
মন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। যা ফ্যাক্ট ইন ইস্যুর সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত নয়। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তাই মনে করি, এসব রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালত কর্তৃক বিচার্য হতে পারে না। আমরা তার এই বক্তব্যে দুঃখিত।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনও একক ব্যক্তির কারণে হয় নাই’-রায়ের কোনও এক জায়গায় প্রধান বিচারপতি এ কথা লিখেছেন। এ বিষয়ে আমি মর্মাহত।’
এই রায়ের মাধ্যমে সরকার ও বিচারবিভাগ মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, একদমই নয়। এই রায় আইনগতভাবে মোকাবিলা না করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করছেন কেন, এই প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘এই রায় আমরা আইনগতভাবেই মোকাবিলা করবো। তবে রায়ের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক যে বিষয় বলা হয়েছে, সেই ইস্যুতে যদি রাজনীতিবিদরা কিছু বলে তাহলে আমার কিছু বলার নাই।’
রায়ে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে বলে এগুলো এক্সপাঞ্জ করার আবেদন করা হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। তবে তিনি বলেন, ‘রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করবো কিনা সেই ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা রায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এই রায় সম্পর্কে সরকার যেসব মন্তব্য করছে তাতে আদালত অবমাননা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘উনারা (বিএনপি নেতারা) কোর্ট মানেন না। বিচারকদের সম্মান করেন না। মামলা চলাকালীন আদালতের অনুমতি না নিয়ে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। তাদের মুখে আইনের শাসনের কথা মানায় না।’
আনিসুল হক আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তড়িঘড়ি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। অতীতে বিচারপতি কে এম সোবাহান, বিচারপতি আবদুর রহমানকে অপসারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তোয়াক্কা করা হয়নি।’
গত ৩ জুলাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ‘এক্সপাঞ্জ’ করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।