‘আইসিবি-ফারমার্স ব্যাংকে লুটপাট-এযেন চোরে চোরে মাসতুতে ভাই’
এস রহমান : আইসিবি এবং ফারমার্স ব্যাংকের মধ্যে চোরে চোরে মাসতুতে ভাই এর প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে আইসিবিসহ ফারমার্স ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম উদঘাটিত হয়েছে।এরমধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের হিসাব থেকে রীতিমত ১৫ কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে।এই টাকার কোন হিসাব নেই ব্যালান্স সিটে।
ওদিকে আইসিবির তৎকালীন এমডি মো. ফায়েকুজ্জামানের বিরুদ্ধে ক্ষমতা-বহির্ভূত কার্যকলাপেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশেষত এক্মি ল্যাবরেটরিজ এবং এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ যত টাকার শেয়ার কিনতে পারতেন, তার থেকে বেশি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ছাড়া গ্লোবাল অ্যাসেট নামের কোম্পানির অধীনে সিলেটে নির্মাণাধীন গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নামের পাঁচ তারকা হোটেলের ৩০ কোটি টাকার প্রেফারেন্স শেয়ার ক্রয়, আয়মন টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারিতে ২৫ কোটি টাকার ঋণ প্রদান এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংকের সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার ক্রয় করে। ওই শেয়ারের প্রকৃত মূল্য ৪৫ কোটি টাকা হলেও ১৫ কোটি টাকা প্রিমিয়ামসহ (অভিহিত মূল্যের বেশি) ৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করে আইসিবি। প্রিমিয়ামের ওই ১৫ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
আইসিবির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ অনিয়ম উঠে এসেছে। আইসিবির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইফতেখার-উজ-জামান এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়েকুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রিমিয়ামে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়েছে।
আর ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান এমডি এ. কে. এম. শামীম জানান, ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়ামে শেয়ার কেনার কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ প্রিমিয়াম নেওয়া হয়নি। আবার ফারমার্স ব্যাংকের ২০১৩ সালের নিরীক্ষক হুদা-ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোং জানিয়েছে, প্রিমিয়ামে শেয়ার কেনাবেচা হলে অবশ্যই তা ফারমার্স ব্যাংকের ব্যালান্সশিটে উল্লেখ থাকত।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে ব্যাংকটির শেয়ার ক্রয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। আইসিবির ওপর গত বছরের ৩০ জুনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে এটি ছাড়াও আরও বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্ষদের অনুমতি পাওয়ার চার দিন পর ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংকের সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার ৬০ কোটি টাকায় ক্রয় করে আইসিবি। এর মধ্যে শেয়ার প্রিমিয়াম ছিল ১৫ কোটি টাকা।
অথচ ফারমার্স ব্যাংকের ২০১৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৪০১ কোটি টাকা। এতে শেয়ার প্রিমিয়াম নামে কোনো খাতের উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে আইসিবির পক্ষ থেকেও ব্যাংকটির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের ২০১৩ ও ২০১৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ার প্রিমিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, উভয় বছরে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
আর শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুয়িটি ছিল যথাক্রমে ৪০৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং ৪০৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধনের অতিরিক্ত অর্থ এসেছে সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও অবণ্টিত মুনাফা থেকে। এখানে শেয়ার প্রিমিয়াম নামে কোনো খাত নেই। ধারণা করা হচ্ছে, আইসিবি বা ফারমার্স ব্যাংক বা এ শেয়ার কেনাবেচায় মধ্যস্থতাকারী কেউ না কেউ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে প্রিমিয়ামের ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান হুদাভাসী চৌধুরীর পার্টনার সাবি্বর আহমেদ জানান, প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রি করলে অবশ্যই শেয়ার ইস্যুকারী কোম্পানির মূলধন সম্পর্কিত প্রতিবেদনে শেয়ার প্রিমিয়াম নামক খাতে প্রদর্শন করতে হয়। একই সঙ্গে তা শেয়ারহোল্ডার্স ইক্যুয়িটিতেও যোগ হয়। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় হওয়ার মানে প্রিমিয়ামে শেয়ার কেনাবেচা হয়নি। এ ছাড়া সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের শেয়ার প্রিমিয়ামে কেনা নিয়েও বিষ্ময় প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার প্রিমিয়ামে কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৩ সালে আইসিবি যখন ব্যাংকটির শেয়ার কেনে, তখন শেয়ারবাজারে প্রতিষ্ঠিত ও ১৫-২০ বছরের পুরনো অন্তত ৭টি ব্যাংকের শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছিল ৯ থেকে ১০ টাকা দরে। এ অবস্থায় একটি নতুন ব্যাংকের শেয়ার প্রিমিয়ামে কেনার যৌক্তিকতা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে এই শেয়ার ক্রয়ে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম প্রদান এবং পর্ষদের পরামর্শ অনুসরণ না করারও অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংক ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর আইসিবিকে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৬ কোটি শেয়ার ৭৫ কোটি টাকায় কেনার প্রস্তাব দেয়। এতে আড়াই টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় সাড়ে ১২ টাকা। অথচ আইসিবি সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার কেনে ৬০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি দর পড়ে ১৩ টাকা ৩৩ পয়সা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে আইসিবির পর্ষদ অনুমোদন দিলেও প্রিমিয়াম ছাড়াই ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কেনার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছিল। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি নমনীয় না হলে প্রিমিয়ামের পরিমাণ নিয়ে দরকষাকষি করারও পরামর্শ দেয় পর্ষদ। তবে আইসিবির পক্ষ থেকে দরকষাকষি করা হয়েছে_ এমন নথি পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল।
পরিদর্শক দল তাদের অভিমতে সম্ভাব্য অনিয়মের দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, প্রিমিয়ামের টাকা ব্যাংকের হিসাবে যোগ না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আইসিবি যোগাযোগ না করার ব্যাখ্যা নেই। এটিকে অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইসিবির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয়।
জানতে চাইলে আইসিবির বর্তমান এমডি মো. ইফতেখার-উজ-জামান বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ের সময় দায়িত্ব ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না।’ তবে তিনি নিশ্চিত করেন, ব্যাংকটির শেয়ার ক্রয়ে ১৫ কোটি টাকা প্রিমিয়াম দিয়েছে আইসিবি।
একই বিষয়ে আইসিবির সাবেক এমডি মো. ফায়েকুজ্জামানের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আইসিবিতে নেই। এ বিষয়ে কথা বলা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।’ তবে এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রিমিয়ামেই ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়েছিল। যদি শেয়ার প্রিমিয়ামের টাকা ব্যাংকটি তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ না করে, তার দায় ফারমার্স ব্যাংকের।
এক্সটার্নাল অডিটর হুদাভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর পার্টনার সাবি্বর আহমেদ জানান, ২০১৩ সালের ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক হিসেবের নিরীক্ষা করে তার প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংক তাদের হিসাবে শেয়ার প্রিমিয়ামের টাকা রাখলে অবশ্যই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হতো।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সার্বিক অবস্থাদৃষ্টি মনে হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। অভিযোগটা যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে পাওয়া গেছে, সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উচিত হবে পুরো বিষয়ে আরও তদন্ত করা। এক্ষেত্রে অনিয়ম হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
আইসিবিতে ব্যাপক অনিয়ম :
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে আইসিবির তৎকালীন এমডি মো. ফায়েকুজ্জামানের বিরুদ্ধে ক্ষমতা-বহির্ভূত কার্যকলাপেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশেষত এক্মি ল্যাবরেটরিজ এবং এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ যত টাকার শেয়ার কিনতে পারতেন, তার থেকে বেশি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্গ্নোবাল অ্যাসেট নামের কোম্পানির অধীনে সিলেটে নির্মাণাধীন গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নামের পাঁচ তারকা হোটেলের ৩০ কোটি টাকার প্রেফারেন্স শেয়ার ক্রয়, আয়মন টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারিতে ২৫ কোটি টাকার ঋণ প্রদান এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণাধীন সিলেট গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নামের ৫ তারকা মানের হোটেলের ৬ বছর মেয়াদি ৩০ কোটি টাকার প্রেফারেন্স শেয়ার কেনার অনুমোদন দেয় আইসিবির পর্ষদ।
শর্ত ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মানের কোনো আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলের সঙ্গে এ হোটেলের চুক্তি থাকতে হবে। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ থেকে ২৪ জুলাই সময়ের মধ্যে তিন কিস্তিতে আইসিবি প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কেনে। অথচ এ সময় এমন কোনো চুক্তি ছিল না। তা ছাড়া হোটেলটির নির্মাণ কাজও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল জানায়, সিলেটের প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে আইসিবির ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এরপর পর্ষদকে জানায় প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ২৬৫ কোটি টাকার মধ্যে ১২৩ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে আরও ১৪২ কোটি টাকা প্রয়োজন এবং বাকি নির্মাণ কাজ শেষ হবে পরবর্তী ৯ মাসে।
তবে ওই ১৪২ কোটি টাকা কীভাবে জোগান দেওয়া হবে, তার দিকনির্দেশনা ছিল না। এ অবস্থায় প্রকল্পটির কাজ শেষ না হলে আইসিবিকে মেয়াদ শেষে কীভাবে অর্থ পরিশোধ করবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ বলে মন্তব্য করে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের মঞ্জুরিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে এমন বিনিয়োগ করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল।