`অভ্যুত্থানের নায়ক তাহের হত্যায় দায়ী সেনাপ্রধান জিয়া’
প্রিয়া রহমান.ঢাকা:
৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে যদি অভ্যুত্থান না হতো, তাহলে এই বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়ার মতো রক্তাক্ত হতো। কিন্তু অভ্যুত্থানের নায়ক তাহেরকেই প্রতিবিপ্লবীরা হত্যা করে। এর জন্য দায়ী প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিনিধি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
আজ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক দ্বীপে এক আলোচনা সভায় এই অভিমত দেন আলোচকেরা। ৩৯তম সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদ এ আলোচনার আয়োজন করে।
আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। সভায় ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ এগিয়েছে না পিছিয়েছে, সে প্রশ্নও ওঠে।
সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম আকাশ বলেন, ‘৭ নভেম্বরের বিপ্লবের আউটকাম খুবই খারাপ হয়েছে। বিপ্লবের নায়ক ফাঁসিতে মারা গেলেন, এটা শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি। তাহলে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে দেশ এগোলো না পেছালো?’
এ প্রসঙ্গে তৎকালীন জাসদ আর বর্তমান জাসদের কিছু পরিবর্তনের উল্লেখ করে এম এম আকাশ বলেন, আজকের জাসদ আর তখনকার জাসদ এক নয়।
তখন জাসদের প্রধান স্লোগান ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এখন তা নয়। এখন জাসদ হয়তো ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদের পক্ষ নিয়েছে। তিনি বলেন, তখন আওয়ামী লীগ ছিল জাসদের শত্রু, এখন মিত্র। তাতে একটা প্রশ্ন জাগে, কর্নেল তাহেরের আদর্শ অনুসরণ করব, না জাসদ করব। দুটো একসঙ্গে চলতে পারে কি না, এর তিক্ত আত্মসমালোচনা দরকার। আওয়ামী লীগ জাসদকে ব্যবহার করছে, না জাসদ আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করছে, এটি এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
পরে হাসানুল হক ইনু তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে জাসদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করেছি বলেই কি বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন? বামপন্থীরা, সিপিবি কি আন্দোলন করেনি? নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা কি পাপ?’ তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান একজন মীরজাফর। বঙ্গবন্ধু এই মীরজাফরকে চিনতে পারেননি। আমরাও চিনতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিয়ে কাফফারা দিয়েছেন। আমরা জিয়ার সঙ্গে কোনো আঁতাত করিনি। কিন্তু জিয়া কেন ক্ষমতায় গেল তার জন্য আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে।’
ওই সময় জাসদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্নজনের সমালোচনার প্রতি ইঙ্গিত করে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘যাঁরা শেখ হাসিনা-খালেদাকে এবং জাসদ-খালেদাকে এক পাল্লায় মাপছেন, তাঁরা কোনদিন বুঝতে পারবেন না, ১৫ আগস্টের পর মাথা নিচু করে নির্যাতন সহ্য করার দল জাসদ না। আমাদের মাথা উঁচু করে প্রথম শক্ত প্রতিবাদের প্রচেষ্টা ছিল সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান।’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কিছুক্ষণ ক্ষমতায় ছিলাম। এর মানে এই নয় যে দেশকে পিছিয়ে দিয়েছিলাম।’
ইনু আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আমি নব্য রাজাকার বলি। যাঁরা জঙ্গিবাদ নিপাত যাক স্লোগান দিতে পারেন, রাজাকারের সমালোচনা করতে পারেন, তাঁরা নব্য রাজাকার খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করে তাঁকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে বলতে পারেন না কেন?’ তিনি বলেন, ‘এই জায়গাটা হচ্ছে আপসের ধূসর জায়গা। যেখানে কতিপয় কালো কোটপরা নামকরা বুদ্ধিজীবী হাঁটছেন।’
আলোচনায় হাসানুল হক ইনু জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ‘জঘন্য আঁতাতকারী’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, খালেদ মোশাররফই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাই যাঁরা খালেদা মোশাররফকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সতর্ক হতে বলব।
কর্নেল তাহেরের ভাই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, এ কে খন্দকার একটি বই লিখেছেন, বইটি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সমস্যা শুধু একে খন্দকার নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব সেনা কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় বা অবস্থার চাপে পড়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের একটা অবস্থান আছে। তিনি বলেন, সেনানায়কেরা যখন বই লিখেন, তখন তাঁরা ৭ নভেম্বর, একাত্তরকে হঠাৎ করে আসা ঘটনা মনে করেন।
এম এম আকাশের বক্তব্যের রেশ ধরে আনোয়ার হোসেন বলেন, জাসদের পরিবর্তনগুলোকে স্থান-কাল-পাত্রের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এখন জাসদ মহাজোট সরকারে যোগ দিয়ে মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে।
কর্নেল তাহের সংসদের সহ-সভাপতি মোশতাক হোসেন ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও জাসদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনার কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘সিরাজুল আলম খানেরা মুখ খুলছেন না। এই অবস্থায় আজ এ নিয়ে অনেকে রগরগে উপন্যাস, বইপত্র লিখছেন। একসময় আমাদের দলও করত, এসব কুলাঙ্গারেরা এখন মিথ্যাচার করছে।’
সভাপতির বক্তব্যে হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে একটি বিপ্লবী প্রয়াস ছিল। কিন্তু প্রতিবিপ্লবীদের কাছে সে প্রয়াস পরাজিত হয়। জিয়াউর রহমান প্রতিবিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। আমার মতে, পরাজয়ের অনেক কারণের মধ্যে বড় ভুল ছিল জিয়ার ওপর আস্থা স্থাপন করা।’