অবৈধভাবে এনআইডি হাতিয়ে মানিলন্ডারিং
লাবণ্য চৌধুরী : অবৈধভাবে এনআইডি হাতিয়ে নিয়ে মানিলন্ডারিং হুন্ডি বাণিজ্যসহ টাকা পাচার করে চলেছে একটি দুবৃত্ত্ব চক্র। এরা দেশের বিভিন্ন জেলার দরিদ্র লোকজনকে নানা সহযোগিতার ফাঁদে ফেলে তাদের এনআইডি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ নিয়ে খুরছে লাখো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। এরপর এসব মোবাইল সিম দিয়ে চলছে মানিলন্ডারিং হুন্ডি বাণিজ্যসহ টাকা পাচার ব্যবসা।
এই চক্রের সহযোগী অ্যামাজন ডট থ্রি এস ডট কম নামের ভূয়া কোম্পানি। এরা ফেসবুকে অবৈধ বিজ্ঞাপন দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জমজমাট প্রতারণা করে চলেছে। এই চক্র মাসিক বেতন দিয়ে বাংলাদেশীদের অবৈধ কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কেউ ওদের এ্যাপে ক্লিক করলেই এরা বাংলায় কথা বলে সাড়া দিচ্ছে।
বলছে বিনিয়োগ করলে মোটা অঙ্কের লাভ মিলবে এই ফাঁদে ফেলে ভুয়া অ্যামাজন প্ল্যাটফর্ম থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার লোকজনকে ফতুর করছে।
রাজধানীর মিরপুর থানায় জালিয়াতির এক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে
এদের জারিজুরি ফাঁস হয়েছে। দেখা গেছে, দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এমটিএফইর প্ল্যাটফর্ম থেকে জালিয়াতি করতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যেসব নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, একই নাম্বার অ্যামাজন চক্রের কাছেও ছিল। পুলিশ জানায়, সরকারি সহযোগিতা দেয়ার কথা বলে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মাড়েলহাট গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারাজুল হকের কাছ থেকে কৌশলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ছবি নেন দুই ব্যক্তি। এর পর একটি মেশিনে তার ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফারাজুলকে এক কেজি আটা দেয়া হয় এবং একইভাবে মাথাপিছু এক কেজি আটার বিনিময়ে তার বাড়ি থেকে আরও চার-পাঁচজনের এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে যায়। তাদের অজান্তেই এনআইডি ও আঙুলের ছাপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খোলা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। আবার সেগুলো দিয়ে জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা প্রতারণামূলক লেনদেন করা হচ্ছে।
এই ঘটনা শুধু ঠাকুরগাঁওয়ে নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জেলার দরিদ্র লোকজনকে নানা সহযোগিতার ফাঁদে ফেলে তাদের এনআইডি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ নিয়ে খোলা হয়েছে লাখো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব সিমকার্ড ভয়াবহ সব অপরাধী চক্রের হাতে তুলে দিচ্ছে জালিয়াত চক্র। এসব জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর চালু করে দিনের পর দিন চলছে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড।
গত সোমবার সারাদেশে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে মিরপুর থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-রবিউল, চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার সাব্বির করিম আহমেদ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের জোবায়ের আলম, বহদ্দারহাটের মোক্তার হোসেন, চন্দনাইশের অন্ত দে, বায়েজিদ বোস্তামির ফজলুল করিম নাহিদ ও কক্সবাজারের অনিক ইসলাম।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াত চক্রটি প্রথমে প্রতারণামূলক মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর খোলে। তাদের কৌশল হলো, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক অসাধু ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার ও ডিস্ট্রিবিউশন সেলস সুপারভাইজার তাদের কোম্পানির এজেন্টের মাধ্যমে ওয়ান টাইম পিন (ওটিপি) নিয়ে থাকে। এর পর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তাদের এনআইডি নম্বর নিয়ে হিসাব নম্বর খোলে। এরপর এসব মোবাইল সিমগুলো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়। এভাবে হিসাব নম্বর খোলার পর তা অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের কাছে বিক্রি করে জালিয়াত চক্রটি।
গ্রেপ্তারকৃত অনিকের কাছ থেকে ছয়টি মোবাইল ও ২৮টি সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি সিমকার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর খোলা রয়েছে। তবে তার মধ্যে একটি মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরও অনিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ব্যবহার করে খোলা হয়নি। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চকরিয়ায় তোরাব আলী নামে তার চাচাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় তার বাসা থেকে ৬৮টি সিমকার্ড জব্দ করে পুলিশ।
এ জালিয়াত চক্রের প্রতারণার শিকার বরগুনার আমতলীর রিকশাচালক মো. মোজাম্মেল। গত ১৩ মে কারা জেলার পরিচয় দিয়ে বলা হয়– ‘তোমার আব্বা বরিশাল কারাগারে রয়েছে। সিরিয়াল নম্বর-৭১। সরকারিভাবে কিছু লোক জেলখানা থেকে ছাড়া হচ্ছে। ৪০ হাজার টাকা পাঠালে তোমার বাবাকে জামিনের ব্যবস্থা করিয়ে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ এরপর জালিয়াত চক্রকে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে ৪০ হাজার টাকা পাঠানোর পরও দরিদ্র রিকশাচালক তার বাবাকে ফেরত না পেয়ে হতাশ হন। পর তিনি এ ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।
মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, গ্রেপ্তারকৃত চক্রটি কয়েক লাখ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব অবৈধভাবে খুলেছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা স্বাস্থ্যকার্ড দেয়ার নামেও কৌশলে অনেকের এনআইডি ও আইরিশ নিয়েছিল। যেসব দরিদ্র মানুষের এনআইডি কার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন চলছে তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয় বলেও জানান তিনি।পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংসেবার সঙ্গে যুক্ত, তারা সচেতন না হলে এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকানো কষ্টসাধ্য হবে। অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যাবে। আবার সতর্ক না হলে নিরপরাধ লোকজন ফেঁসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।