অবশেষে ব্যবসায়ীরা খুশী
বিশেষ প্রতিনিধি : নানা সমালোচনা ও বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে বহুল আলোচিত নতুন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে এলো সরকার। আগামী দুই বছরের জন্য এ আইনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ফলে বর্তমানের ১৯৯১ সালের আইনটি বহাল থাকছে।
গতকাল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর নিয়ে এতদিন ধরে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহলের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল, তার অবসান হলো। তবে অনেকেই বলেছেন, দীর্ঘ ছয় বছর ধরে আলোচনা সভা, সেমিনার ও সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে ভ্যাট আইন প্রণয়ন, এরপর বাজেটে ঘোষণা দিয়ে তা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছরে আইনটি কার্যকর করার কথা ছিল।
ব্যবসায়ীসহ বিভন্ন মহলের বিরোধিতার কারণে আইনটি বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে সরকার। সরকারি নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে আগামী নির্বাচনে ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। ভোট হারানোর ভয়ে এ মুহূর্তে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার।
এমন বাস্তবতা বিবেচনা করেই এ আইন কার্যকর থেকে পিছিয়ে আসে সরকার। এদিকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর না করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তারা খুশি। আরও আলাপ-আলোচনা করে পর্যায়ক্রমে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হলে দেশের জন্য মঙ্গল হবে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, সরকারের উচিত হবে সবার সঙ্গে বিশদ আলোচনা করে পর্যায়ক্রমে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা।
গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে নানা কথা উঠেছে। ব্যবসায়ীরাও সাড়া দেননি। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দুই বছরের জন্য আইনটি স্থগিত করার অনুরোধ করছি। কাজেই বর্তমান যে আইন (১৯৯১) রয়েছে, তা সেভাবেই চলবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো ভ্যাট চালুর পর নতুন আইনের খসড়া প্রণয়ন শুরু হয় ২০০৮ সালে।
খসড়া আইন তিন বছরের ধরে চলার পর তা সংসদে পাস হয় ২০১২ সালে। এ আইন নিয়ে যারা সমালোচনা করেছেন, তারা এখন ভুলে গেছেন। এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি, নতুন আইন কার্যকর না করে বর্তমান আইন অব্যাহত রাখাই ভালো হবে। নতুন আইন কার্যকর না করার জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একটি সূত্র বলেছে, তৃতীয় মেয়াদে আবার ক্ষমতায় এলে তখন হয়তো নতুন ভ্যাট আইনটি কার্যকর করা হতে পারে। তার আগ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের আইনটিই বলবৎ থাকবে। এনবিআর সূত্র বলেছে, নতুন আইন কার্যকর না হলেও রাজস্ব আদায়ে কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ ১৯৯১ সালের আইনে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন করে বাড়তি রাজস্ব আহরণের সুযোগ আছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে প্রণীত মূল্য সংযোজন কর আইনটি বহু সংশোধনীর পর অফলপ্রসূ হয়ে পড়ায় ২০০৮ সালেই একটি নতুন ভ্যাট আইন প্রণীত হয়। এটি নিয়ে প্রায় চার বছর আমরা বিভিন্ন আলোচনা-বিতর্ক চালিয়ে যাই। অবশেষে ২০১২ সালে নতুন আইন সংসদে পাস হয়।
এ আইনটির কার্যকারিতা কিন্তু ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে। এ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিধায় এবারের বাজেটে আইনটি কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সংসদ সদস্যগণ তাদের মতামত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ভ্যাট আইনের পূর্ণ কার্যকারিতা পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করছি।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী সংসদে নতুন ভ্যাট আইন ছাড়াও ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক, চালের শুল্ক কমানোসহ আরও কিছু বিষয়ে সংশোধনীর প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা অর্থবিল-২০১৭-এর মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো সর্বসম্মতিক্রমে কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে এবারের বাজেটের কর প্রস্তাবগুলো পাস হলো। আজ পাস হবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট। পয়লা জুলাই থেকে কার্যকর হবে নতুন বাজেট।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে নতুন ভ্যাট প্রণয়ন করেছিল সরকার। বর্ধিত ঋণ কর্মসূচির (ইসিএফ) আওতায় একশ’ কোটি ডলার বা সমপরিমাণ আট হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে এ আইন প্রণয়ন করা হয়।
জানা যায়, নতুন ভ্যাট আইনে কিছু বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে। প্রাক-বাজেট আলোচনাসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানে ভ্যাট হার কমানো হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীসহ সবার মধ্যে স্বস্তি আসে অর্থমন্ত্রীর এমন আশ্বাসে।
কিন্তু গত ১ জুন ২০১৭-১৮ বাজেট ঘোষণার পর সবাই হতাশ হন। সর্বক্ষেত্রে ভ্যাটের হার একই (১৫ শতাংশ) রাখা হয় এবং একাধিক হারে বিশেষ ছাড় দিয়ে আগের নিয়ম বাতিল করা হয়। বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই নেতারা নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন বা একই হারে ভ্যাট আদায় করা সম্ভব নয়।
এ আইন কার্যকর হলে আদায়ে জটিলতা বাড়বে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতিবিদসহ অন্য ব্যবসায়ীরা একই মন্তব্য করেন। ঈদের ছুটির আগে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী জানান, ভ্যাট আইন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা :নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত খুশি। তারা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ী সমাজ অত্যন্ত খুশি। ভ্যাটদাতা ব্যবসায়ী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা এখন পর্যাপ্ত সময় পেয়ে ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারবেন।
ফলে বাস্তবায়ন করার সময় এ নিয়ে আর কোনো অস্বচ্ছতা থাকবে না। আইনটি খুবই ভালো। যেহেতু আমরা কেউই এখানও পুরোপুরি প্রস্তুত নই সে কারণে বাস্তবায়ন নিয়ে এতদিন কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। এখন বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ায় সেই সংশয় কেটে গেল। ব্যবসায়ীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে বিজিএমইএও স্বাগত জানিয়েছে। এক প্রতিক্রিয়ায় বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অবশ্যই এটা ভালো সিদ্ধান্ত। ভ্যাট বাবদ আদায় করা অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হয় কি-না সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যে যে সন্দেহ আছে সেটা এখনও কাটেনি। এটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। এখন বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ায় সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে আরও সুযোগ পাবেন। ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন এবং প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ হারের তুলনায় আরও সহনীয় হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হবে বলে আশা করেন তিনি।