অবরোধ-আন্দোলন টানতে বেকায়দায় বিএনপি জোট
শফিক আজিজ.ঢাকা: ২০ দলীয় জোট নেত্রী হলেও খালেদা জিয়াকে একাই রিস্ক নিতে হচ্ছে। লাগাতার অবরোধ আন্দোলনের ঘোষণা কর্মসূচি তিনি একাই নিয়েছেন। আন্দোলনের মাঠে নেই অনেক শরীক দলের নেতারা।জামায়াতে ইসলামি রাজশাহী ছাড়া তেমন কোন এলাকায় সেভাবে সক্রিয় নেই। নেতা-কর্মীদের মামলায় অনেকের পথ চলাই দায় হয়ে পড়েছে।
দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ প্রায় ছয় দিন যাবৎ গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। পুলিশ তাঁকে বের হতে দিচ্ছে না। পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তিনি কোনো বৈঠক বা তাদের কোনো দিকনির্দেশনাও দিতে পারছেন না। গুলশান কার্যালয়ের সামনে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে নেতা-কর্মী দূরে থাক, দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবী বা শুভানুধ্যায়ীরাও অনেকে সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
এ অবস্থায় অবরোধ-আন্দোলন টানতে বেকায়দায় বিএনপি জোট। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই আগামীকাল ৯ জানুয়ারি থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদের পারে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এ পরিস্থিতিতে অন্তত তিন দিন (৯, ১০ ও ১১ জানুয়ারি) অবরোধ না দেওয়ার জন্য বিএনপির ওপর চাপ আছে।হেফাজতে ইসলাম গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে কিছুদিনের জন্য অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত টার্গেট অনুযায়ী সরকারবিরোধী আন্দোলন টেনে নেওয়াই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ গত দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে জনগণের দুর্ভোগ থাকলেও ঢাকাসহ সারা দেশেই তা ইতিমধ্যেই অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। ২০ দলের নেতা-কর্মীরা তেমন একটা মাঠে না নামায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
লাখ লাখ মুসল্লির ভোগান্তির কথা চিন্তা করে বিএনপির একাংশ তিন দিন ছাড় দিয়ে আবার ১২ জানুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মসূচি পালনের পক্ষে। ছাড় দেওয়ার ‘বিরোধী’ বিএনপির অপর অংশের মতে, সুযোগ বা ফাঁক পেলে সরকার দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করবে। দলের এ অংশ অবরোধ কর্মসূচি শিথিল হয়ে পড়লেও তা অব্যাহত রাখার পক্ষে। তবে শেষ বা আখেরি মোনাজাতের দিন তারা ১২ ঘণ্টার জন্য অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের পক্ষে বলে জানা যায়।
গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দলটি ধরে রাখতে পারেনি, যা পরবর্তী মূল্যায়নে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে বিএনপি মনে করে। দলটির নেতাদের মতে, নির্বাচনের পরও ওই সময় দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি লাগাতারভাবে অব্যাহত রাখা হলে সরকার চাপের মুখে পড়ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তখন বিএনপি জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের সুযোগ পেত না। এলাকায় অবস্থানও সংহত করতে পারত না বলে দলটি মনে করে। ফলে এক বছর পরের এ আন্দোলনে এবার ক্ষমতাসীন সরকারকে বিএনপি সুযোগ দিতে চাইছে না। আন্দোলনকে তারা টেনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ভয় পায় বলেই জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দিন এভাবে আন্দোলন দমানো যায়নি। যে পরিস্থিতি, আন্দোলন এমনিতেই বেগবান হবে বলে মনে করেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের মতোই দেশে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন এ দেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত সফল করবে এবং বিএনপিই এর নেতৃত্ব দেবে। তিনি বলেন, আন্দোলন বিএনপির টেনে নিতে হবে। সময় হলে জনগণই এর পুরোভাগে থাকবে। গণতন্ত্র হরণের এ চ্যালেঞ্জও দেশের জনগণই মোকাবিলা করবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আন্দোলন ২০ দলকে টেনে নিতে হবে না। সরকার নিজেই জুলুম-নির্যাতন করে এই পথ তৈরি করে দেবে। তিনি বলেন, এই যে লাগামহীন গ্রেপ্তার-নির্যাতন এগুলো আন্দোলনকে আরো বেগবান করবে। কারণ এগুলো আন্দোলনের খোরাক। জামায়াতের এই নেতা জানান, যতই গ্রেপ্তার বা আটকে রাখা হোক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত চলবে।
এদিকে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা দেওয়ার সুযোগও কমে গেছে। কারণ পলাতক থাকাকালে তাঁর বক্তব্য-বিৃবতি সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা যাবে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের আশঙ্কার মধ্যে তারেকের বক্তব্যের ওপর নিষেধাজ্ঞাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের বক্তব্যই দলের নেতা-কর্মীদের কাছে দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করার কথা।
এদিকে দলের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে ইতিমধ্যে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী অন্য তিন নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আগে থেকেই কারাগারে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ ও মহানগরী বিএনপির আরেক নেতা সাদেক হোসেন খোকা রয়েছেন বিদেশে। ৫ জানুয়ারির সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির পর মহানগরীর প্রভাবশালী গুরুত্বপূর্ণ নেতা মির্জা আব্বাসসহ অধিকাংশ নেতা-কর্মী এখন চলে গেছেন আত্মগোপনে।এ ছাড়া আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে জামায়াতের শক্তিও অনেকটাই ক্ষয় হয়ে গেছে। সরকারের নানা আনুকূল্য পেয়ে হেফাজতে ইসলামও আন্দোলনের ব্যাপারে গতকাল পর্যন্ত বিএনপিকে সবুজ সংকেত দেয়নি। তবে বিএনপির প্রতি আগের তুলনায় তারা নমনীয় হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শরিক অপর কোনো দলকেই এ পর্যন্ত আন্দোলনের ঝুঁকি নিতে দেখা যায়নি। ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মহানগরী কার্যালয়ও এখন নেতা-কর্মীশূন্য। পুলিশ ওই অফিস দুটি ঘেরাও করে রেখেছে। এ অবস্থায় আন্দোলন কিভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে তা নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় বেশির ভাগ নেতাই বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন বলে খবর নিয়ে জানা গেছে।