• শনিবার , ২৩ নভেম্বর ২০২৪

অপহরণ গুম হত্যা : জড়িতরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে


প্রকাশিত: ৩:০৬ এএম, ৬ মে ১৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৮০ বার

এস এম খলিল বাবু, ঢাকা ৬ মে ২০১৪:  সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ আর গুমের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে।

প্রতিদিনই অপহরণ-গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটছে। কারও লাশ মিলছে নদীনালা আর ডোবায়; কারও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর, তারাও এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারছে না।

সবশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ একই সময় সাতজন অপহরণের পর নড়েচড়ে বসেছিলেন সরকারের এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রসাশনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা।

কিন্তু অপহরণকারীরা এতই শক্তিশালী যে,অপহৃতদের আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বুধবার বিকালে শীতলক্ষ্যা নদীতে নজরুলসহ চারজনের লাশ ভেসে উঠেছে। গুমের দেশে সবাই যেন অসহায়!

র‌্যাব-পুলিশের পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর অপহরণকারীরা ধরা পড়েছে, এমন নজির নেই বললেই চলে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে; জানাও যাচ্ছে না নেপথ্যের হোতাদের। হতভাগ্য স্বজনরা জানেন না, এর শেষ কোথায়; কবে শেষ হবে তাদের অপেক্ষার প্রহর; কার কাছে বিচার চাইবেন? রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছেও এসব প্রশ্নের সদুত্তর নেই।

যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, গুম বা অপহরণের সঙ্গে সরকারের কোনো যোগসাজশ নেই। বিগত বছরের সঙ্গে তুলনা করছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলছেন, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

গুম-হত্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। কিন্তু সরকারের এই দাবি মানতে নারাজ সাধারণ মানুষ এবং মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, অপহরণ-গুম-গুপ্তহত্যার মতো মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। যারাই এসব ঘটাক, সরকারকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে যেসব অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর কোনো সুরাহা হয় না। কারা, কেন এসব ঘটাচ্ছে, তার কিছুই জানা যাচ্ছে না। এ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক বাড়ছেই। অভিযোগ উঠেছে, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা ঘটনার কোনো তদন্তই হয় না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জানতে চাইলে বলা হয়, সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে। তবে ওই অপহরণকারীরা আর গ্রেফতার হয় না। বছরের পর বছর শুধু তদন্তই চলে, উদ্ঘাটন হয় না রহস্য। কোথাও চাপের মুখে পুলিশ অভিযোগ নিলেও তদন্ত হচ্ছে নামেমাত্র। মাত্র কয়েকটি ঘটনায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তদন্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। স্বজনরা বলছেন, তদন্ত লোকদেখানো। যারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারা আর কীভাবে তদন্তে রহস্যের উদ্ঘাটন করবে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র- আসকের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৬৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার ও ২৪ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো খোঁজই মেলেনি।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছর মাত্র তিন মাসেই অপহৃত হয়েছেন ৩৯ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ১৯ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি; লাশ মিলেছে ১৬ জনের; ছেড়ে দেয়া হয়েছে চারজনকে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি মাত্র সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। তবে লাশ পেলে হত্যা মামলা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে রাজধানীর উত্তরা থেকে অপহরণ করা হয় যুবদল নেতা ও ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম সোলায়মানকে। একদিনের মাথায় শনিবার সকালে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে নিজ এলাকা লক্ষ্মীপুর থেকে।

১৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার মধ্যনগরের নিজ বাসার পাশ থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হন স্বপন মিয়া। চার দিন পর ফতুল্লা এলাকা থেকে তার জবাই করা লাশ উদ্ধার হয়। রোববার দুপুরে এ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক থেকে অপহৃত হন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজন। প্রায় একই সময়ে ওই সড়ক থেকে নিখোঁজ হন নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক। এদের মধ্যে চারজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়।

তবে জীবিত কিংবা লাশের জন্য অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু, পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ, ২০১১ সালের নিখোঁজ হওয়া ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা একেএম শামীম আক্তার ও ইলিয়াস আলীসহ শত নিখোঁজ পরিবারের স্বজনদের। কবে তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে, তা-ও জানা নেই তাদের।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নূর খান বলেন, ‘খুন-গুম-অপহরণ মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। যারাই এসব ঘটনা ঘটাক, এর জন্য রাষ্ট্র বা সরকারকে দায় নিতে হবে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এসব ঘটনায় দেশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, আর দেশের ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অপহরণ-খুন-গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত নয় বলে দাবি করে সরকার দায় এড়াতে পারে না।’

এদিকে অপহরণ-গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা। বুধবার কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ চারজনের লাশ উদ্ধারের পর নারায়ণগঞ্জে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, আর কত লাশ দরকার গডফাদারদের। দিনে-দুপুরে অপহরণ করা হলেও পুলিশ তিন দিনেও কেন তাদের উদ্ধার করতে পারল না।

এর আগে সোমবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, গুম-অপহরণ-গুপ্তহত্যা সীমা অতিক্রম করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখিনি, জানি না ও বুঝি না বললে চলবে না। এটা কোনোভাবে আইনি শাসন নয়।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, অপহরণ বা নিখোঁজের বিষয়গুলো পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখে। এসব ঘটনায় পুলিশের অনেক সফলতাও আছে। তবে এখনও যারা নিখোঁজ আছেন, তাদের উদ্ধারে সার্বক্ষণিক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তবে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ আর গুমের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এখন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন।

তিনি বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উচিত হবে তাঁদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। নয়ত আইন এবং আইনের শাসনের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা দেয়া। তাই সেটা দিতে না পারলে সরকারের প্রতিও দেশের মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হবে।”