• বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’তে শুভঙ্করের ফাঁক আছে’


প্রকাশিত: ২:৫৭ এএম, ২৬ মার্চ ২১ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৯৫ বার

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : ১৯১১-তে দিল্লি দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতে এসেছিলেন। এক ফাঁকে গোখেলের সঙ্গে কিছু কথা হয়। গোখেলের কাছে সম্রাটের প্রশ্ন ছিল: ‘বৃটেন ভারতের উন্নয়নের জন্য এতকিছু করছে, তবুও তোমরা কেন স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব?’ কালবিলম্ব না করে গোখেলে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতা আমাদের আত্মমর্যাদা দেবে।’ গোখেলে ঠিকই বলেছিলেন। নইলে কবি কেন বলবেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়।’ আমরাও স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চাইনি; লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছি। তবে আমাদের স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষার আরো কারণ ছিল; পাকিস্তানের ২৪ বছর ৪ মাস ৩ দিনে আমরা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন আস্বাদন করতে পারিনি। কাজেই আমাদের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন- আকাঙ্ক্ষার সমার্থক ছিল। প্রশ্ন হলো: প্রায় ২৫ বছরে যা পাইনি, তা কি বিগত ৫০ বছরে পেয়েছি? সম্পূরক দুটি প্রশ্ন উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২-এর ভাষণ থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে, যার ভিত্তি কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না।
বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ পরে যোগ হয়েছিল জাতীয়তাবাদ। ফলে সংবিধানে (৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২) চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্দেশ করা হয়। সংবিধান অনুমোদনের দিন গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের আদর্শ ঠিক হয়ে গেছে। এই আদর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশ চলবে।’ বঙ্গবন্ধু আদর্শ বলতে চার মূলনীতি ভিত্তিক আদর্শের কথা বলেছিলেন। এখন প্রশ্ন দুটো হলো: বাংলাদেশ কতটুকু আদর্শ রাষ্ট্র হলো? এবং চার মূলনীতির আদর্শ কতটুকু প্রতিফলিত হলো? হিসাব মেলানোর প্রেক্ষাপট পেলাম; এখন মোটা দাগে বিগত ৫০ বছরের খতিয়ান নেয়া যেতে পারে।

স্বাধীনতা বাঙালিকে আত্মমর্যাদা দিয়েছে, ইতিহাসে বাঙালি এই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে, পেয়েছে আত্মপরিচয়। পতাকা আর সার্বভৌমত্ব; সবুজ পাসপোর্ট এসব কিছুর প্রতীক। জন্মলগ্নে অবশ্য আমাদের মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। হেনরী কিসিঞ্জারের অভিসস্পাত ছিল, আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি হবো। দুজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফায়াল্যান্ড এবং জে. আর. পার্কিনসন বলেছিলেন আরো কিছু নেতিবাচক কথা। এক, বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কঠিনতম সমস্যার একটি। দুই, বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে সব দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব হবে। তিন, বাংলাদেশের উন্নয়ন যদিও হয়, তাহলে অন্তত দু’শ’ বছর লাগবে।

দুর্মূখের অভিসম্পাত ও আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য। বর্তমান সরকার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। মাঝে ’৭৫ থেকে ’৯০, ’৯০ থেকে ’৯৬; এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ ছিল নষ্ট সময়, যখন বাংলাদেশ ছিল বেপথু। ২০১৬-তে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোলমডেল’ হিসেবে তকমা দেয়। এখন তো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের তকমা পাওয়া গেছে। আর্থসামাজিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ যে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে, সে কথা তো অমর্ত্য সেন তার Uncertain Glory বইতে বলেছেন। দু’শ’ বছরেও যে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হওয়ার কথা নয়, সে রাষ্ট্র ৫০ বছরেই যা অর্জন করেছে তাতে সারাবিশ্ব এখন বলছে ‘সাবাস বাংলাদেশ/ অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়।’ আমরা গর্বিত। আমাদের আত্মশ্লাঘা বোধে বুক আজ স্ফীত। পদ্মা সেতু আমাদের অহঙ্কার। বিশ্বব্যাংকের গালে চপেটাঘাত করে আমাদের জনগণের টাকায় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্তে এ সেতু সর্বৈব আমাদের। জনগণই তো সব করবে; সরকার নিমিত্ত মাত্র। কারণ সংবিধানের ৭(১) ধারা জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা দিয়েছে। কাজেই জনগণের টাকায় জনগণের সম্পদ এ সেতু; কোনো দল ও গোষ্ঠীর নয়।

কিন্তু আমাদের glory তো অণুপুঙ্খ বিচারে uncertain। বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে তা প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন নয়। কারণ উন্নয়ন মানে সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির ফসল বৈষম্যহীন ভাবে বন্টিত হলে উন্নয়ন নিশ্চিত হবে; আর এ কাজটি বাংলাদেশে এখনো করা হয়নি। বৈষম্য ক্রমবর্ধমান; গত দেড় দশকে ৬০-৭০ ভাগ বৈষম্য বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে অসদুপায়ে রাতারাতি ধনী হওয়া যায়, এমন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আছে। আর স্বাধীনতার লগ্নে গণদারিদ্র্য ছিল প্রায় আশিভাগ; এখন তা একুশ ভাগের কাছাকাছি। অর্থাৎ গণদারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু ধন ও আয়বৈষম্য বেড়েছে। তাজউদ্দীনের বাজেটে বৈষম্য কমানোর দর্শন ছিল; এখনকার বাজেট আমলাতান্ত্রিক আয়-ব্যয়ের হিসাবমাত্র। উপরন্তু অর্থমন্ত্রী একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী; স্বভাবগত কারণে তিনি মুনাফা শিকারি। আর কাজির গরুর মতো সংবিধানে সমাজতন্ত্র আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই; বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি পুঁজিবাদী। বৈষম্যপূর্ণ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে ছিল না; মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নেও ছিল না। তিনি সব সময়ে শোষণমুক্তির কথা বলেছেন, যার সঙ্গে বৈষম্য সঙ্গতিহীন।

ধর্ম নিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্রের মতো কাজির গরু; সংবিধানে আছে, মুখে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই। কারণ ১৫তম সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়েছে; যার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু একই সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম সহাবস্থান করে কী করে? তেলে-জলে কি মেলে? সরকার মেলাতে চাইলেও তা অবাস্তব। ফলে সংবিধান এখন গোঁজামিলের দলিল। ৪ নভেম্বর ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সংবিধানহীন জাতি মাঝিহীন নৌকার মতো। কাজেই এখন তো দেখছি সংবিধানেই সমস্যা। তাহলে আওয়ামী লীগের নৌকা চলছে কী করে? রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ ১২ (খ) ধারা অনুযায়ী কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেয়া যায় না। সাংবিধানিক মর্যাদা রাজনৈতিক মর্যাদার চেয়ে বড়। আর সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকলে রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক হয়, যা বঙ্গবন্ধু চাননি।

দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারি ঐকান্তিকতা ও পারঙ্গমতা দৃশ্যমান নয়। যাদের ঘামে-শ্রমে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সেই কৃষক ধানের দাম পান না। অথচ শামসুর রাহমানের পঙ্‌ক্তি আছে, ‘স্বাধীনতা মানে ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’ আমাদের কৃষক কি এখন হাসে? শাসনে আমলতান্ত্রিক প্রাবল্য দৃশ্যমান। সুশাসন তো পরের কথা, শাসনই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ বিচার ব্যবস্থা। সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবেদন ৭৯ বার পিছিয়েছে; ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র আজও দেয়া হয়নি। তনু-মিতু হত্যার কূলকিনারা হলো না। এদেশে তো তাহলে ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’ শিক্ষার তো হ-য-ব-র-ল অবস্থা। শিক্ষার ওপর তলার খবর ভালো নয়। ৪৬টি জনবিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন উপাচার্য অভিযুক্ত। মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গেলে হয় ‘যেন দীমরু পথে হারালো ধারা।’ দেখে-শুনে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে এ দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়/উপাচার্য নেই, এবং তা সংজ্ঞার্থ/নিহিতার্থ অনুযায়ী। মনে কী পড়ে না শামসুর রাহমানের পঙ্‌ক্তি: ‘উদ্ভট এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ?’

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আমাদের অর্থনীতি সচল, কিছু কিন্তু সত্ত্বেও আগুয়ান; বিপরীতে রাজনীতি প্রতিদিনই অনুন্নয়নের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ওপরে ওঠে; রাজনীতি নিচে নামে। রাজনীতি-অর্থনীতির বৈপরীত্য অশনিসংকেত। রাজনীতি না এগুলে অর্থনীতির অর্জন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাজনীতিতে গুণগত বাঁক বদল সম্ভব হবে নেতৃত্বের গুণে-কর্মে; যা এখন দৃশ্যমান নয়। আমাদের নেতা আছেন অনেক, নেতৃত্ব নেই। আমাদের শাসক আছেন, শাসন নেই। নেতৃত্ব ঠিক হলে সব ঠিক হবে; বাংলাদেশের ইতিহাস তাই বলে। মেঠো প্রজ্ঞায় বলে, মাছের পচন ধরে মাথায়।

গণতন্ত্রের প্রতি ঐকান্তিক অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ’৭২-এর সংবিধান আমাদেরকে ভালো পুঁজি দিয়েছিল; কিন্তু বিগত ৫০ বছরে আমরা পুঁজির মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। অবশ্য ’৭৫ থেকে ’৯০ আমাদের হারানো নষ্ট সময়। কারণ বন্দুকধারী নেতা দেশে জংলি শাসন কায়েম করেছিল। ’৯০-এ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ ঘটেছিল; কিন্তু আজও গণতান্ত্রিক অবয়ব দৃশ্যমান হলো না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখন এক চাকার সাইকেল; কিন্তু সাইকেল তো এক চাকায় চলে না। সার্কাসে ভাঁড় এক চাকায় সাইকেল চালায়, তবে বেশিদূর যেতে পারে না। গণতন্ত্র বলতে এখন যা বিরাজমান তাকে democracy না বলে বলতে হবে demosclerosis; যখন democracy+ sclerosis = demosclerosis। Sclerosis একটি রোগ যাতে ধমনী শুকিয়ে যায়, শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয় না। ফলে মানুষ হয়ে পড়ে নির্জীব; সচল-সজীব থাকে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দশা এমনই। বাংলাদেশের রাজনীতিও তাই। রাজনীতির নিহিতার্থ জননীতি। এখন তা নেই, আছে ক্ষমতা নীতি। মানে ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করা, আর ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশায় উদগ্র হওয়া।

আমরা বিগত পঞ্চাশ বছরে পেয়েছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যাতে শুভঙ্করের ফাঁক আছে; কিন্তু হারিয়েছি গণতন্ত্র। গণতন্ত্র হারিয়ে পাওয়া, পেয়ে হারানের গল্প। আর চার মূলনীতি তো এখন হারানো দিনের হারানো সুর। সুতরাং পঞ্চাশ বছরের অর্জন নিয়ে আমাদের এখনো যেতে হবে বহুদূর। চার্চিলের কথাছিল, ‘তুমি যত দূর পেছনে তাকাবে, ততদূর সামনে তাকাতে পারবে।’ আমাদের ফেলে আসা পঞ্চাশ বছরের দিকে তাকিয়ে আগামীর স্বপ্ন নির্মাণ করতে হবে। কারণ স্বাধীনতার অনেক সুবর্ণ ফসল এখনো তোলা হয়নি।লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্‌স (বিইউপি)