• বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সেজান কারখানার আগুনের রেশে পাকরাও হাশেম পরিবার


প্রকাশিত: ১:২৭ এএম, ১১ জুলাই ২১ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫০ বার

বিশেষ প্রতিনিধি/রুপগঞ্জ প্রতিনিধি : সেজান কারখানার আগুনের রেশে পাকরাও হাশেম পরিবার। তাদের রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ।

লাশ তো নয় সব কয়লা- এ অবস্থায় লাশের খোঁজে আসা স্বজনদের কান্না আর আহাজারি’তে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে ভস্মীভূত সেজান জুস কারখানার সামনেও ছিল নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারি । তারা নিজেরাই ভবনের বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ আপনজনদের খুঁজে বেড়ান। এসময় অনেকই মূর্ছা যান। তাদের চিৎকারে কারখানা এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কারখানার ধ্বংসস্তূপের ভিতর লাশের সন্ধানে তল্লাশি চালান। তবে কারখানার ফ্লোরে থাকা দাহ্য পদার্থ ও ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। প্রতিটি ফ্লোরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেমিকেল থেকে রবিবারও ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস মাঝে মধ্যে পানি ছিটিয়ে পোড়া কেমিকেলের ধোঁয়া বন্ধ করছিল।

ওদিকে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনায় চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের আট কর্মকর্তাকে গেফতার করে তাদের ৪ দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আট কর্মকর্তা হলেন, সজিব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম, তার ছেলে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিব বিন হাসেম, অন্য তিন ছেলে তারেক ইব্রাহিম, তাওসিফ ইব্রাহিম, তানজিব ইব্রাহিম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, ডিজিএম মামুনুর রশীদ ও অ্যাডমিন প্রধান মো. সালাউদ্দিন। শনিবার বিকালে পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান আট কর্মকর্তাকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠান। নারায়ণগঞ্জ আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফাহমিদা খাতুন ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। শনিবার সকালে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদার বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় সজীব গ্রুপের ৮ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে সামান্য ও গুরুতর জখম করার অভিযোগ আনা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাশেম ফুডস এ্যান্ড বেভারেজের চারটি ভবনের প্রতিটিতে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা রয়েছে। একটি কমপ্লায়েন্ট কারখানা বলতে যা বুঝায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না হাসেম ফুডস এ্যান্ড বেভারেজে। চারদিকে ইট, বালু, সিমেন্ট, রাসায়নিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের বস্তা, কার্ড এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন রকম কার্টন ও অব্যবহৃত আসবাবপত্রের স্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অগ্নিকান্ডে সেজান জুস কারখানা ভবনের সবকটি ফ্লোর এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

রবিবারও ফায়ার সার্ভিস কেমিকেল পোড়া ধোঁয়ায় পানি ছিটিয়ে বন্ধ করতে দেখা গেছে। কারখানার প্রতিটি ফ্লোর ৩৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের। প্রতিটি ফ্লোরে এক শিফটে ৭শ’ শ্রমিক কাজ করেন। বিশাল ফ্লোরে শ্রমিকদের ওঠানামার জন্য দুই প্রান্তে মাত্র দুইটি সিঁড়ি রয়েছে। কারখানায় কাজ চলাকালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, সরু দুই সিঁড়ি দিয়ে শ্রমিকরা বের হতে গেলে আবারও দুর্ঘটনা ঘটবে। কারখানা ভবনের বাইরে দিয়ে জরুরী বহির্গমনের কোনো সিঁড়ি নেই। প্রতিটি ফ্লোরে নেই কোনো ফায়ার ইস্টিংগুইসার। নিচতলা আগুন নেভানোর জন্য জরুরী পানির পাইপ লাগানো ছিল, তাও সরু।

ভবনের ছয় তলায় ছিল কার্টনের গুদাম। কিছু কার্টন ছিল জুস তৈরির রাসায়নিক কাঁচামাল। আর পঞ্চম তলায় রাখা হতো বিভিন্ন রাসায়নিক ও প্লাস্টিক মোড়ক। চতুর্থ ও তৃতীয় তলায় উৎপাদিত হতো সেজান জুসের বিভিন্ন পণ্য। তবে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাশেই সারি সারি রাখা ছিল পণ্য ভর্তি কার্টন। তৃতীয় তলায় ক্যান্ডি লাইন নসিলা উৎপাদনের প্লান্ট। এ ফ্লোরে ছিল যাবতীয় ফ্লেভার, সুগার ও গ্লুকোজ কার্টন এবং মোড়ক উৎপাদনের পলিথিন।

চতুর্থ তলায় স্টোরসহ লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, আচার, ঝাল মুড়ি তৈরি হতো। তবে এই ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেলের ড্রাম ছিল। ইলেকট্রিক চুলায় বড় সাইজের ৪/৫ টি কড়াই ছিল। ঘটনার সময় কড়াইয়ে আচার তৈরির কাজ চলছিল। অগ্নিকান্ডের পর ফুটন্ত তেল ও ড্রাম ভর্তি তেল জ্বলে গিয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছি। এসব কয়েক ঘণ্টা ধরে জ্বলে পুড়ে লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, আচার, ঝাল মুড়ি ছাই হয়ে গেছে।

নিচ তলায় ছিল কার্টন এলডিপি বা প্লাস্টিকের পলি উৎপাদন প্লান্ট। এখানে আরেকটি স্থানে প্রসেস করা হতো ময়দা। ছিল কম্প্রেসার মেশিন। রাখা ছিল ফয়েল পেপারের বড় বড় রোল। যা আগুন ধরে যাওয়ার পর কালো ধোঁয়া বের হত। পাশেই ছিল আঠা জাতীয় রাসায়নিক উপাদানের প্লাস্টিকের কয়েকটি ড্রাম। দ্বিতীয় তলায় লিচু ড্রিঙ্কস ও লাচ্ছি তৈরি হতো। তৈরি হতো এসব পণ্যের প্লাস্টিক বোতলও। ছিল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল রেজিনের মতো দাহ্য পদার্থ। এসব কেমিকেল ভর্তি অর্ধশত প্লাস্টিকের ড্রাম দেয়াল দিয়ে সাজানো ছিল। নিচতলা ছিল সব ড্রিঙ্কস ও বিস্কুট উৎপাদন প্লান্ট। এখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। মূলত পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার দুটি ফ্লোরে গুদাম হিসেবে রাখা হলেও সবকটি ফ্লোরেই ছিল রাসায়নিক উপাদান ভর্তি কার্টন, প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে ঠাসা।

শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সারা দেশ এ ঘটনায় স্তব্ধ। একসঙ্গে এতজনের প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। ঘটনায় সামান্যতম জড়িত, গাফিলতি কিংবা কারো অজান্তে ত্রুটি করে থাকলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ২০৩ ও ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ৩ নারী শ্রমিককে ৫০ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম আব্দুস সালাম। আহত শ্রমিকরা হলেন, আমেনা বেগম, মাজেদা বেগম ও হালিমা আক্তার।শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম আব্দুস সালাম বলেন, যারা জীবন বাঁচাতে উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে ২ লাখ টাকার চেক প্রদান করেছি। পর্যায়ক্রমে আহত সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে সহায়তা করা হবে।