• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

সরকারকে বিপাকে ফেলতে চালের বাজারে সিন্ডিকেট


প্রকাশিত: ৩:১৯ পিএম, ১৬ জুন ১৭ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৮২ বার

বিশেষ প্রতিনিধি :  সরকারকে বিপাকে ফেলতে দেশের চালের বাজার পরিকল্পিতভাবে অস্থির করা হচ্ছে। দেশের rice-www.jatirkhantha.com.bdইতিহাসে চালের দাম এত বাড়েনি-এবার যেভাবে বাড়ছে। দেশে চাল সংকট বুঝে বোরো চাল কিনে ফেলেছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রে রয়েছে মিল মালিক আড়তদার ও মজুদদাররা।

অন্যদিকে সরকার চাল সংকট জেনেও চাল আমদানি করছে না রহস্যজনক কারণে। ওদিকে আগামী সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ নতুন চাল আসার সম্ভাবনা কম। এ অবস্থায় সরকার আমদানি ট্যারিফ না কমালে চাল নিয়ে বেহাল অবস্থা সৃষ্ঠি হতে পারে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ঠরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারে ৪৬ টাকার কমে কোনো চাল নেই। সরকারি হিসাবেই গত এক মাসে সাধারণ মানের মোটা চালের দাম বেড়েছে আট শতাংশের বেশি; আর এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। মোটা চালের ভোক্তা প্রধাণত নিম্নআয়ের মানুষ। আর যারা সরু চাল কেনার সামর্থ্য রাখেন, তাদের এখন প্রতি কেজিতে গুণতে হচ্ছে কেজিতে ৬০ টাকার বেশি। এক বছরে এ ধরনের চালের দাম বেড়েছে সরকারি হিসেবে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।

প্রধান খাদ্য চালের দাম গত তিন মাস ধরে বাড়তে থাকায় কষ্টে পড়েছে সাধারণ মানুষ। চালের বাজার যেভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের মত খাদ্য সঙ্কট ফিরে আসার লক্ষণ দেখছেন একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ।২০০৭-২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সেইসব দিনে বাংলাদেশে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকায় উঠেছিল। সরু চালের কেজি বেড়ে হয়েছিল ৫৬ টাকা। স্বাধীনতার পর সেটাই ছিল চালের সর্বোচ্চ দর।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্মনীয় ফেলো এম আসাদুজ্জামান বলেন, বিশ্বজুড়ে চালের তীব্র সঙ্কট দেখা দেওয়ায় সে সময় দেশের বাজারে দাম বেড়েছিল হু হু করে। সারা দেশে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এ বছর হাওরে আগাম বন্যায় বোরো ফসলের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ছাড়া প্রায় সব দেশেই চাল উৎপাদন কমেছে। চীনে কমেছে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ; ভিয়েতনাম ও ভারতেও কমেছে।

শেখ হাসিনার সরকারের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম ওঠানামা করলেও চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। মোটা চালের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, আর সরু চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। টানা কয়েক বছর বাম্পার ফলনের কারণে ওই সময় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৬ শতাংশের নিচে। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই চালের বাজার অস্থির; দাম বেড়েই চলেছে।সংশ্লিষ্ঠরা বলওেছন, মিল মালিক ও আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার কিছুই করছে না। সম্পূর্ণ উদাসীন!

শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, রামপুরা,  হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বর্ণা, পাইজাম, চায়না ইরির মত ভালো মানের মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর নিম্নমানের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়। মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মত সরু চাল ৫৬ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে চালের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার ঢাকার বাবুবাজার-মৌলভীবাজারে চালের দাম খুচরা বাজারের চেয়ে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা কম।

পাইকারদের ভাষ্য, চালের দামের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। মিল থেকে কেনা দামের সঙ্গে প্রতি বস্তায় ৫৫ টাকা পরিবহন খরচ ধরে তার ওপর ১০ থেকে ১৫ টাকা লাভ রেখে তারা পাইকারিতে বিক্রি করেন। কুষ্টিয়ার একটি মিল মোটা চালের বস্তা ১৯৫০ টাকা (কেজিতে হয় ৩৯ টাকা) এবং মিনিকেট ২৬০০ টাকায় (কেজিতে দাঁড়ায় ৫২ টাকা) ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে এই পরিস্থিতি বলে মিল মালিকদের ভাষ্য।

মিল মালিকরা বলছেন, প্রতি মণ ধান কিনতে ১২শ টাকার বেশি লাগছে। প্রতি মন ধানে চাল পাওয়া যায় ২৭ কেজির মত। অবশ্য খুদ আর কুড়া থেকে উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ উঠে আসে।    বোরো মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ২৪ এবং চাল ৩৪ টাকায় কিনছে সরকার।

অামদানিকারকরা বলছেন, চাল আমদানির ক্ষেত্রে সবমিলিয়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক তুলে দেয়া হলে আমদানি বাড়বে এবং তাতে দামও কমবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) তথ্য অনুযায়ী, ১২ জুন সরকারি গুদামগুলোতে ১ লাখ ৯৩ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন চাল ছিল। আর গত বছর একই দিনে মজুদের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ২০ লাখ টন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে এফপিএমইউ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের পাইকারি দর এখন ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা ৫০ পয়সা। আর খুচরা দাম ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা।

গত ২ মে থেকে বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরুর পর ১১ জুন পর্যন্ত ১৯ হাজার ৫৩২ টন সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।পুরান ঢাকার বাবুবাজারের মেসার্স শুভ শান্ত রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. সেলিম বলেন, অন্যান্য বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে বোরো ধান উঠলে চালের দাম কমে যায়। কিন্তু এবার চিত্রটা পুরো ব্যতিক্রম। নতুন চাল বাজারে আসার পরও চালের দাম আরেক দফা বেড়েছে।

পাইকাররা বলছেন, হাওড়ে ফসল নষ্টের অজুহাতে নতুন চাল আসার পরও মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর ধাপে ধাপে দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে একটি চক্র (সিন্ডিকেট)। শুভ শান্ত রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. সেলিমের অভিযোগ, মিল মালিকরা ধান মজুদ করে বাজারে চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। ফলে বোরো মৌসুমে নতুন চাল ওঠার পরও দাম কমার পরিবর্তে বেড়েছে।

এক সময় সনাতন পদ্ধতির চাতাল থেকে চাল উৎপাদন হলেও এখন চালের বড় অংশের সরবরাহ আসে অটো রাইস মিল থেকে। কুষ্টিয়া, শেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের অটো রাইস মিল চালু হয়েছে।

বাবুবাজারের মেসার্স চৌধুরী রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক আবদুল জব্বার ভাণ্ডারি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প গ্রুপগুলো অটোমিল করে সারা দেশের চাল নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সরকার চালের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় নামিয়ে আনতে পারছে না।

গত এপ্রিলে বোরো ধান ওঠার আগে থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নতুন চাল বাজারে আসার পরও চালের দাম বেড়ে যাওয়ার এমন ঘটনা আমার ২৫ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে শুনিনি। এই পাইকার বলছেন, বড় মিলগুলো বেশি পরিমাণে ধান কিনে মজুদ করায় ছোট মিল ও চাতালগুলো ধান কিনতে না পেরে ব্যবসা হারাতে বসেছে।

বাবু বাজারের আরেক চাল ব্যবসায়ী এমদাদ হোসেন বলেন, নতুন চাল ওঠার পর তৃতীয় দফায় মোটা চালের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকার কোনো উদ্যোগ না নিলে সঙ্কট আরও বাড়বে। এক দিকে ধানের সঙ্কট, অন্যদিকে ধানের ওপর মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণ এবং পুঁজিপতিদের মজুদের কারণে চালের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।

ঢাকার মিরপুরে দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলের ব্যবসায় জড়িত নিউ বিল্লাল রাইস এজেন্সির মালিক ওয়াহিদুজ্জামান জানান, গত মে মাসে ঢাকায় চালের বিক্রি ২/৩ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। জুন মাসে চালের দাম বাড়বে এমন হুজুগে লোকজন প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল সংগ্রহ করেছে তখন।

যার এক বস্তা লাগবে সে তিন বস্তা কিনেছে। তখন হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে মিল মালিকরাও দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে এখন ঢাকায় চালের বিক্রি কমে গেছে। মিল মালিকরাও চালের দাম কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি কতদিন ঠিক থাকে তা বলা মুশকিল।