• বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

টিক্কা খানের আদেশনামাই ৩০ লাখ গণহত্যার দলিল


প্রকাশিত: ১:৪৮ পিএম, ২৫ মার্চ ১৭ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৯৭ বার

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) : অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম রাত শেষে 71bangladesh rawforman ali-www.jatirkhantha.com.bd.11১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত নিজের কমান্ড পোস্ট থেকে বাইরে এসে শহরের দিকে তাকিয়ে জেনারেল টিক্কা খান বিদ্রূপের হাসিতে তাঁর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিককে বলেছিলেন, ঢাকা শহরে কয়েকটি নেড়ি কুত্তা ছাড়া মানুষজন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে সিদ্দিক সালিক সেদিনের সকালের দৃশ্যপটের স্মৃতিচারণায় এ কথাগুলোই লিখেছেন। একাত্তরে মাত্র আট মাস ২২ দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩০ লাখ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে রেকর্ডকৃত তথ্যমতে এত স্বল্প সময়ে এত বড় ভয়ংকর গণহত্যা বিশ্বে আর কোথাও হয়নি। উপরোক্ত এই গণহত্যা পাকিস্তান সেনাবাহিনী চালায় আনুষ্ঠানিক লিখিত মিলিটারি অপারেশন আদেশ জারি করে।
71bangladesh-www.jatirkhantha.com.bd
এটা মূর্খতা ও গোঁয়ার বুদ্ধির পরিচায়ক এবং সীমাহীন ঔদ্ধত্যের উদাহরণ। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান অত্যাধুনিক কাল পর্যন্ত বিশ্বের বহু প্রান্তে অনেক রকমের এবং বহু ডাইমেনশনের গণহত্যা হয়েছে, যার কোনোটিই লিখিত সামরিক আদেশ জারি করে করা হয়নি। যেখানে যা ঘটেছে, তা করা হয়েছে ক্ল্যানডেস্টাইন (গোপন পরিকল্পনা) পন্থায় এবং গোপনীয় বা বিশেষ বাহিনীর দ্বারা। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে হয়েছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে। তাদের অভিযান শুরু হওয়ার পরই কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাই জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে আগ্রাসী এবং প্রথম আক্রমণকারী দেশ।

22সুতরাং কনভেনশন অনুযায়ী এই যুদ্ধের সব দায়দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তানের ওপর। পাকিস্তান এই সেনা অভিযানের কোড নেম বা সাংকেতিক নাম দেয় অপারেশন সার্চলাইট। সার্চলাইটের প্রথম পর্ব চলে মধ্য মে মাস পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় সার্চলাইট দ্বিতীয় পর্ব, যা বলবৎ থাকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম পর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন সব মহকুমা শহর, গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, ব্যবসাকেন্দ্র এবং যোগাযোগব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুগুলো দখল ও নিয়ন্ত্রণে নেয়। দ্বিতীয় পর্বে তারা দেশব্যাপী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো হয় প্রথমত প্রতিরোধ যুদ্ধ, দ্বিতীয়ত গেরিলা যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ফাইনাল অফেনসিভ, অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর আক্রমণ ও বিজয়। অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম পর্বের প্রথম রাতে (২৫ মার্চ রাত) পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযান চালায় ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেট শহরে, অর্থাৎ সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানকৃত শহরগুলোকে তারা প্রথম টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। 71bangladesh-www.jatirkhantha.com.bd.1

গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন ঢাকা শহরের দায়িত্বে, আর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বা জিওসি) মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ছিলেন ঢাকা ছাড়া অন্য শহরগুলোর দায়িত্বে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ খান ১৭ মার্চ খাদিম হোসেন রাজাকে সার্চলাইটের আদেশনামা চূড়ান্ত করার হুকুম দেন। খাদিম হোসেন রাজা ও রাও ফরমান আলী ১৮ মার্চ একত্রে ঢাকা সেনানিবাসে বসে অপারেশনের আদেশনামা চূড়ান্ত করেন।

এখানে উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয়ার্ধে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে পরামর্শের পর পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযানের জন্য সেনাপ্রধান হামিদ খানকে প্রস্তুত হতে বলেন। জেনারেল হামিদ খান ও পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর ও সামরিক প্রধান টিক্কা খান একত্রে ২০ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের অনুমোদন দেন। এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) গুল হাসান কয়েকবার রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় গুল হাসান ও টিক্কা খান, দুজনে মিলে থিওরি দেন, সাড়ে সাত কোটির মধ্যে ২৫-৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করলে কিছু যাবে-আসবে না।

বরং তাতে সব ঠিক হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান রক্ষা পাবে। আগামী ৩০ বছর নিশ্চিন্তে বাঙালিদের শাসন করা যাবে। এই থিওরির সূত্র ধরেই ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা ত্যাগকালে বিমানবন্দরে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সঙ্গের অফিসারদের বলেছিলেন, থ্যাংক গড পাকিস্তান ইজ সেভড, অর্থাৎ পাকিস্তান রক্ষা পেল। রাও ফরমান আলী ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে অপারেশন পরিচালনার জন্য ৫৭ পদাতিক ব্রিগেড ও তার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন।

৫৭ ব্রিগেডের অধীনে ছিল ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট, ১৮ পাঞ্জাব, ৩২ পাঞ্জাব, ৩১ গোলন্দাজ এবং ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। সার্চলাইটের আদেশনামায় রাও ফরমান আলী সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট উল্লেখপূর্বক আদেশ দেন কোন সেনাদল কোথায় অভিযান চালাবে। আদেশনামায় টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেন ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, ঢাকা হল এবং শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

একইভাবে অন্যান্য সেনা দলকে আলাদা আলাদাভাবে পুরান ঢাকা, শাঁখারীবাজার, পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে টার্গেট হিসেবে নির্দিষ্ট করে আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় বিষয় হলো, লিখিতভাবে সামরিক অপারেশন আদেশনামায় বেসামরিক এলাকা ও মানুষকে টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির জন্য এক কম্পানি কমান্ডো সেনা দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার বাইরে অন্য শহরগুলোয় খাদিম হোসেন রাজা বেসামরিক মানুষ ও আবাসিক এলাকাকে টার্গেট হিসেবে আক্রমণের জন্য নির্ধারণ করে দেন।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কত বড় গণহত্যা চালানো হয় তার চিত্র বোঝার জন্য টিক্কা খানের উক্তিই যথেষ্ট, যে কথা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ এক ডজনের ওপর শিক্ষক এবং কয়েক শ ছাত্রকে হত্যা করা হয়। এক রাতেই শাঁখারীবাজারে নিহত হন প্রায় আট হাজার মানুষ। চকবাজারসহ ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকায়ও একই রকম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পুরান ঢাকায় প্রধানত টার্গেট করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে। ঘুমন্ত নারী-শিশুসহ ঘরবাড়িতে গানপাউডারের মাধ্যমে আগুন দেওয়া হয়।

বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে সারা রাত দাউ দাউ করে পুরান ঢাকায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ২৫ মার্চের ভয়াবহ নৃশংস গণহত্যার বর্ণনা বিশ্ব মিডিয়ায়ও ছাপা হয়। একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ওই রাতে ঢাকায় ছিলেন। পরে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে ৩১ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তিনি তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে। ইকবাল হলকে তারা প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেয়। হলগুলোর ওপর একদিকে উপর্যুপরি ভারী কামানের শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে, অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। শুধু ইকবাল হলেই প্রথম ধাক্কায় ২০০ জন ছাত্র নিহত হয়। দুদিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলোর জানালায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ’ বেসামরিক মানুষের ওপর এমন সমন্বিত অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বে আর কোথাও হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয় ২৫ মার্চ রাতে সারা বাংলাদেশে এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের প্রারম্ভে বলা হয়েছে, Even wars have, limit : civilian should never be targetted. তারপর জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধরত বাহিনীকে ১০টি রুলস বা বিধি মান্য করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, সেখানে তিনটি বিধির মাধ্যমে বিশেষভাবে বেসামরিক মানুষের জন্য রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে এক নম্বর Prohibit targeting civilians. Doing so is a war crime. সংখ্যার দিক থেকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়, যা এখন হলোকাস্ট নামে ইতিহাসে চিহ্নিত। পোল্যান্ড দখল করার জন্য হিটলার যে সামরিক অভিযান চালান তার সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন হিমলার। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারজ’। হিমলার ও বারবারজ—এ দুটি অপারেশনের আদেশনামায় কোথাও বেসামরিক স্থাপনা, মানুষ বা ইহুদিদের হত্যা করার টার্গেট দেওয়া হয়নি, তার উল্লেখও নেই।

অথচ পোল্যান্ড ও রাশিয়ায় ইহুদিদের সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয়। সে হত্যাকাণ্ড চালানো হয় গেস্টাপো (গুপ্তবাহিনী) ও এসএস (প্যারা মিলিটারি) বাহিনীর দ্বারা ক্ল্যানডেস্টাইন পরিকল্পনায়, যার নেতৃত্ব দেন হিটলারের অন্যতম প্রধান সহযোগী হিমলার। কম্বোডিয়ায় ১৯৭৫-৭৯ সালে কমিউনিস্ট লিডার পলপট ও খিউ স্যাম্পেনের নেতৃত্বে খেমাররুজ বাহিনী প্রায় ১৮ লাখ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। কিন্তু এর বিপরীতে লিখিত কোনো আদেশনামা পাওয়া যায়নি।

১৯৯২ সালে আমি নিজে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করার সময় কম্বোডিয়ার গণহত্যা জাদুঘর ও কিলিং ফিল্ডগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছি। গত শতকের নব্বই দশকের মধ্যভাগে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় জাতিগত দাঙ্গায় হুতি গোষ্ঠী তুতসিদের ওপর ভয়ংকর গণহত্যা চালায়। তাতে প্রায় আট লাখ তুতসি নিহত হয়। কিন্তু এর জন্য কেউ লিখিত আদেশ দেয়নি। গত শতকের ষাটের দশকে ইন্দোনেশিয়ার সামরিক শাসক সুহার্তো মার্কিন ছত্রচ্ছায়ায় ১০-১৫ লাখ ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী ও মতাদর্শের বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেন।

তার সব হয় গোপন নীলনকশার মাধ্যমে, লিখিত আদেশে নয়। কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী লিখিত অপারেশন আদেশ দিয়ে গণহত্যা চালায়, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার মূল কালপ্রিট রাও ফরমান আলী। তবে এর জন্য ইয়াহিয়া খান থেকে শুরু করে ডাউন দ্য লাইন গ্রাউন্ডে যারা হত্যাকাণ্ডে গুলি চালিয়েছে, তারা সবাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী। তাই ভবিষ্যতের জন্য মানবতা রক্ষা এবং অস্ত্রধারীদের অস্ত্রের লাগাম টেনে ধরার জন্য এদের সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক