অভিযান ১০ লঞ্চে শত ফ্যামিলির স্বপ্ন ছাই
বিশেষ প্রতিনিধি/ঝালকাঠি প্রতিনিধি : ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭২ জন। তাদের বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর ও বরিশাল টার্মিনালে লঞ্চটি থামে এবং যাত্রী ওঠানামা করেন।
বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া অভিযান-১০ নামের লঞ্চটির যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে বরগুনা যাওয়ার পথে রাত দু’টার দিকে আগুন ধরে যায়।এ সময় আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ তৈরি হয় নদীতে থাকা লঞ্চটিতে এবং আগুন থেকে প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকেন যাদের অনেকে এখনো নিখোঁজ আছেন।
এক পর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামে তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হলেও দ্রুত নামতে গিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের অনেকে আহত হন। কেউ কেউ শিশু সন্তান হারিয়ে এখনো খুঁজে পাননি। একজন যাত্রী বলছেন, যখন মাঝরাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন একদিকে আগুন আর অন্যদিকে পানি-। তখন নদীতে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
তিন তলার একটি কেবিনে থাকা যাত্রী জহিরুল ইসলাম জানান, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিনের দিক থেকে মাঝে মধ্যেই জোরে শব্দ হচ্ছিলো আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোরগুলোও গরম হয়ে উঠছিলো। ইঞ্জিনে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছিলো আর ব্যাপক কালো ধোঁয়া দেখছিলাম। এরপরও লঞ্চের স্টাফরা বলছিলো সমস্যা হবেনা। অবস্থা বেগতিক দেখে জহিরুল নদীতে লাফ দেন এবং প্রায় এক ঘণ্টা ভাসার পর তীরে আসতে সক্ষম হন। আগুনে তার দুই পা পুড়ে গেছে।
তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর এক ইঞ্জিনে চলছিলো লঞ্চটি। পরে চাঁদপুর ছাড়ার পর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি চালু করা হয়।এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ব্যাপক চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দরজা খুলে দেখি আগুন দেখা যাচ্ছে। স্টাফরা তখনো বলো ধৈর্য্য ধরেন। কিন্তু আগুনের উত্তাপ সইতে না পেরে দিলাম নদীতে ঝাঁপ।যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে সুগন্ধা নদী হয়ে বরগুনা যাচ্ছিলো। হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায় এবং রাত দু’টার পর থেকে রাত তিনটার মধ্যে সম্পূর্ণ লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়।
এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি রানিং ছিলো বেশ কিছুটা সময়। এ সময়ে বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যাত্রীবাহী সব লঞ্চের মতো এটিতেও যাত্রীদের প্রচুর পরিমাণ কাপড় আর ভেতরে ফ্লোরে কার্পেটের মতো থাকায় দ্রুতই আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।তিন তলা লঞ্চটির নীচতলা পেছনের অংশে ছিলো ইঞ্জিন রুম। এরপর থেকে সামনের অংশ পর্যন্ত কিছু মালামাল আর অনেক যাত্রী ছিলো, যারা মূলত কার্পেটের ওপর কাপড় বিছিয়ে নিজেদের ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছিলেন।
নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ থেকে শুরু করে লাগেজ বা বস্তা ছিলো অনেক যাত্রীর সাথে। কিন্তু ঠিক কতো যাত্রী ছিলো তার কোন তথ্য কারও কাছে নেই। লঞ্চটিতে আগাম টিকেট কাটার ব্যবস্থা ছিল না।দোতলার সামনের অংশে কেবিন আর বাকী অংশের পুরোটাই খোলা জায়গা যা ডেক হিসেবে পরিচিত।সেখানে অনেক পরিবারে নারী ও শিশু থাকায় কাপড় দিয়ে নিজেদের থাকার জায়গা ঘিরে দিয়েছিলো। আবার নীচতলা ও দোতলার ডেকের অংশে লঞ্চটির দু’পাশে পর্দা হিসেবে ত্রিপল দেয়া ছিলো।
আমেনা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী তার বাবা মায়ের সঙ্গে দোতলায় ছিলেন।তিনি বলেন, মনে হয় আজানের আগে হঠাৎ বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বাবা-মাসহ তিন তলার ছাদের উঠে গেলাম। দেখি আগুন নেভেনা। একপর্যায়ে একেবারে কাছে চলে আসলো আগুন। তখন আমি লাফ দিলাম। পরে বাবাকে পেলেও মাকে এখনো পাইনি বলে জানিয়েছেন তিনি।মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামে আরেকজন যাত্রী বলছেন, মধ্যরাতে ২/৩ টা শব্দ শুনতে পান তারা। এরপর নীচে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আগুন, আবার উপরে রওনা দিয়ে দেখেন সেখানেও আগুন দেখা যাচ্ছে।
চারদিকে কাপড় লাগানো। এক পর্যায়ে কাপড় বেয়ে নীচে নেমে লঞ্চের সামনের দিকে চলে যাই। দেখি যাত্রীতে ভরপুর। তার উল্টো দিকে দেখি তীর দেখা যায়। সব খুলে প্যান্ট পড়ে ঝাঁপ দেই পানিতে। দু ‘মিনিট পরে নদীর পাড় পেয়ে যাই,” বলছিলেন তিনি।নদীতে অনেক নারী পুরুষকে সাঁতরানোর চেষ্টা করতে দেখেছেন তিনি। তীরে পৌঁছার পর নিজের জামা দিয়ে আরেকটা মেয়েকে সহায়তা করেছেন এই যাত্রী।আমেনা আক্তার বলছেন, ঘুম ভেঙ্গেই তিনি সবদিক থেকে চিৎকার আর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলেন।এরপর তিন তলার ছাদ থেকে যখন লাফ দেন তখন বাবা মায়ের দিকে তাকাবার মতো হুঁশ তার ছিলো না।কখন যে সবাইকে ছেড়ে লাফ দিলাম বুঝতেই পারিনি।
তবে নীচতলা ও দোতলার ডেকের যাত্রীরা আগুন আগে টের পেলেও কেবিনের যাত্রীরা টের পেয়েছেন পরে।মূলত হৈ-চৈ শুনে তাদের অনেকের ঘুম ভাঙ্গে। অনেকে ধোঁয়ায় দমবন্ধ অবস্থায় পড়েন কেবিনের মধ্যে।তিনতলার একটি কেবিনে ছিলেন জহিরুল এবং শব্দ শুনে দরজা খুলে আগুন দেখে হতভম্ব হয়ে যান তিনি।চারদিক থেকে চিৎকারের শব্দ আসছিলো। পরে নদীতে লাফ দেন এবং এক ঘণ্টা পর তীরে আসতে সক্ষম হন।এসব যাত্রীরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
ওই লঞ্চের যাত্রী পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ। ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। ছিলে লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে বের হয়ে দেখেন আগুন লেগেছে। উপায় না পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। তবে ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার স্ত্রীর একটি পা ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। ইউএনও জানান, রিভার ভিউয়ের দিকে কেবিনে যেসব যাত্রী ছিল, তারা অনেকেই বের হতে পেরেছে। যাদের কেবিন লঞ্চের মাঝখানে ছিল, তাদের অনেকেই ধোঁয়ার কারণে বাইরে বের হতে পারেনি।রাতের লঞ্চ ভ্রমণ, তার ওপর আবার শীত। যারা কেবিনে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ঘুমিয়েছিলেন। এ ছাড়া শীতের কারণে অন্য যাত্রীরাও গরম কাপড়ে শরীর মুড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ৩টার দিকে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে সবাই আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী লঞ্চের কেবিন বয় ইয়াসিন (১৯) গণমাধ্যমকে বলেছেন, লঞ্চের নিচতলার পেছনে ইঞ্জিনরুমের পাশেই ক্যান্টিন। সেখানে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং তা দ্রুত ইঞ্জিনরুমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রাখা ১৩ ব্যারেল ডিজেল আগুন বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন চলে যায় ডেকের দিকে।ইয়াসিন আরও জানায়, ডেকের জানালার পর্দায় লেগে তা দোতলায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে প্রথমে পারটেক্স বোর্ডের সিলিংয়ে আগুন লাগে। দোতলায় একটা চায়ের দোকান ছিল। ওই দোকানের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন আরও তীব্র হয়। এভাবে পুরো লঞ্চটি আগুনে পুড়ে যায়।
অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হানজালা বলেন, লঞ্চের কেরানি আনোয়ার রাত ৩টা ৫ মিনিটে তাকে ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন।সে বলেছে দোতলায় একটা বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন দেখা যায়। তার পর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। হানজালা বলছেন, ওই লঞ্চে অন্তত ২১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল, কিন্তু এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে যে, সময় পাওয়া পায়নি। একটি পাইপ গেছে ইঞ্জিন থেকে, সেখানে প্রথম বিস্ফোরণ হয় বলে আনোয়ার আমাকে জানিয়েছে, বলেন লঞ্চের মালিক হানজালা।
বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।সরকারের পক্ষ থেকেও আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দুর্ঘটনায় নিহত সব পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।বরগুনা জেলা প্রশাসন লাশ দাফন এবং সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নিহতদের তালিকা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, অধিকাংশ লাশ এতটাই পোড়া- তাদের চেহারা দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।