• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

অত্যাচারী সাত আরব রাজকুমারী সাজা বাঁচতে শেষমেষ তদবিরে-


প্রকাশিত: ৩:৩৬ পিএম, ২৭ জুন ১৭ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১২৭ বার

ডেস্ক রিপোর্টার :  প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে তাঁরা আসেন, হাতে তাঁদের অঢেল টাকাপয়সা। ইউরোপের বড় বড় শহরে তাঁদের বিচরণ। -amira-www.jatirkhantha.com.bdওই সব শহরের অভিজাত নামী দোকানগুলোয় তাঁরা সওদা করছেন, সঙ্গে আছেন তাঁদের দেহরক্ষীরা আর ম্লান মুখের নারী ক্রীতদাসীরা। ক্রীতদাসীদের হাতে শপিং ব্যাগ অথবা ট্রলি হাতে বাচ্চাদের বহন করার দৃশ্য। তাঁদের দেখা মেলে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে, প্যারিসের শঁজেলিজে অ্যাভিনিউতে, বার্লিনের কুর্ফস্টেনডাম বা আলেক্সান্ডার স্কয়ার, ব্রাসেলস, আমস্টারডামের মতো শহরগুলোয়।
UAE-Eight-princesses-from-www.jatirkhantha.com.bd
এবার ব্রাসেলসের একটি আদালত সভ্য সমাজে এসব ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের অসভ্য আচরণের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছেন। আবুধাবির ক্ষমতাসীনদের এক শেখ পরিবার, যাদের অঢেল ধনসম্পত্তি, তবে মানবিকতার শিক্ষাটি যাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, তারা এবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অমানবিক আচরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।

২৩ জুন ব্রাসেলসের একটি আদালত সেখানকার বিলাসবহুল একটি হোটেলে আটজন আরব রাজকুমারীর ১৫ মাস করে জেল দিয়েছেন এবং প্রত্যেক নারী কর্মচারীকে ১ লাখ ৬৫ হাজার ইউরো শোধ করার আদেশ দিয়েছেন। এই আরব রাজকুমারীরা মাসাধিককাল ধরে তাঁদের ২৩ জন নারী কর্মচারীর সঙ্গে অবমাননাকর আচরণ করেন।ss

ঘটনা ২০০৮ সালের হলেও ব্রাসেলসের একটি আদালত বহু বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আরব রাজকুমারীদের অনৈতিকতার বিচারকাজ শেষ করতে পেরেছেন। পাঁচতারা খচিত হোটেল কনরাড ব্রাসেলসের একটি বনেদি নামকরা হোটেল, যেখানে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা উঠে থাকেন, ঘটনা সেই হোটেলেই।

২০০৮ সালের গ্রীষ্মকাল। সেই হোটেলের চতুর্থ তলার পুরো ফ্লোরের ৫৪টি রুম ভাড়া করেছিলেন আবুধাবির প্রয়াত শেখ আমির মহম্মদ বিন খালদ আল নাহিয়ানের বিধবা স্ত্রী ৭০ বছর বয়স্ক হামদা আল নাহিয়ান এবং তাঁর সাত কন্যা। প্রমোদভ্রমণে এসেছিলেন তাঁরা।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই নাহিয়ান পরিবার পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য পরিবার। এই পরিবারের একজন সদস্য যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল দলের মালিক। তবে সেই বছর নাহিয়ান পরিবারের রাজকুমারীদের ইউরোপের প্রমোদভ্রমণটা ততটা জমজমাট হয়নি, কারণ বেলজিয়ামের আইন।

সেই বছর হঠাৎ করেই ব্রাসেলসের বিলাসবহুল হোটেল কনরাডের চতুর্থ তলায় ৪০ জন পুলিশ হানা দিয়ে মানবেতর অবস্থায় ২৩ জন নারী কর্মচারীকে উদ্ধার করেন। উদ্ধারের পর ব্রাসেলসের পুলিশ জানায় মরক্কো, তিউনিসিয়া, মিসর, সুদান, ভারত ও ফিলিপাইন থেকে আসা খুব গরিব পরিবারের এই মেয়েদের মধ্য দুজন অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে হোটেল থেকে পালিয়ে যান।

তাঁদের একজনকে রাজকুমারীদের দেহরক্ষীরা ব্রাসেলসের বিমানবন্দর থেকে আটক করে চার দিন অভুক্ত অবস্থায় একটি হোটেলকক্ষে আটক রাখেন। অন্যজন তাঁদের ওপর অত্যাচারের বিষয়টি প্রকাশ করে দিলে পুলিশ কনরাডের হোটেলে হানা দিয়ে সব নারী কর্মচারীকে উদ্ধার করেন।

ব্রাসেলসের একটি মানবতাবাদী সংগঠন ওই সময় বিদেশের মাটিতে এসব বিপদাপন্ন মেয়েকে সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেন। সংগঠনটি আইনি পরামর্শ দিলে নারী কর্মচারীদের ১১ জন সাত শাহজাদি ও তাঁদের মা হামদা আল নাহিয়ানের বিরুদ্ধে শারীরিক অত্যাচার, মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা, মাসের পর মাস বেতন না দেওয়া ও তাঁদের পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোনের সিমকার্ড কেড়ে নেওয়ার দায়ে মামলা ঠুকে দেন।

ব্রাসেলসের হোটেলে পুলিশি অভিযান ও শাহজাদিদের বিরুদ্ধে মামলা হতে যাচ্ছে আঁচ করতে পেরে শাহজাদিরা ত্বরিত ব্রাসেলস ত্যাগ করে আবুধাবিতে চম্পট দেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার ও ব্রাসেলসে তাঁদের রাষ্ট্রদূত ক্ষমতাসীন পরিবারের যাতে সম্মানহানি না ঘটে, সে কারণে ঘটনাটি চাপা দিতে এবং আদালতে মামলাটি স্থগিত করতে দীর্ঘদিন চেষ্টা চালান।

তবে বেলজিয়ামের সরকারি কৌঁসুলিরা দীর্ঘ সময় ধরে ওই সব নারী কর্মচারী, যারা রাজকুমারীদের পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলিরা ব্রাসেলসের আদালতকে জানান, এই অমানবিক ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব।

নানা দেশের দরিদ্র পরিবারের এই নারী কর্মচারীরা যাঁরা বয়সে তরুণী এবং ভাগ্য অন্বেষণে ধনী রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্তি পেয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে প্রাচীনকালের ক্রীতদাসের মতো আচরণ করা হতো। তাঁদের কাজের কোনো সময়সীমা ছিল না।

সপ্তাহের সাত দিনই তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। গভীর রাতে চা বানাবার ফিরিস্তি বা রাজকুমারীদের সন্তানদের কোনো কিছুর প্রয়োজনে তাঁদের ডাক পড়ত, রাতে ঘুমানো বা অবসরের জন্য তাঁদের কোনো সময় নির্দিষ্ট ছিল না।

ওই রাজপরিবার হোটেলের চতুর্থ তলার পুরো ফ্লোরের ৫৪ কক্ষ ভাড়া নিলেও নারী কর্মচারীদের অনেককেই লবিতে ঘুমাতে বাধ্য করা হতো। এত কিছু করার পরও রাজকুমারীরা নারী কর্মচারীদের নিত্যদিন অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন, সব সময় তাঁরা তাঁদের কুকুর, গরু বা বেশ্যা বলে তিরস্কার করতেন। এই মানবেতর কাজের জন্য তাঁদের বেতন মিলত পনেরো হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। তা দেওয়া হতো অনিয়মিতভাবে।

২৩ জুন ব্রাসেলসের আদালত রাজকুমারীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ঘটনাটি ২০০৮ সালের হলেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ঘটনা এখনো ঘটছে বিধায় আমাদের সবাইকে প্রাচীন ক্রীতদাসপ্রথার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজকুমারীদের পক্ষের আইনজীবী তাঁর মক্কেলদের নির্দোষ দাবি করে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।