• শুক্রবার , ২৬ এপ্রিল ২০২৪

হলি আর্টিজান হত্যাযজ্ঞে জঙ্গি নাশকতায় রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়-


প্রকাশিত: ১১:১৮ এএম, ১ জুলাই ১৭ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৯২ বার

এস রহমান  :  আজ ১ জুলাই-নৃশংস হলিআর্টিজান হত্যাযজ্ঞ দিবস। আজকের এই দিনে ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনা holy artizan-killer gongi-www.jatirkhantha.com.bd4ঘটে। এতে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সারা দেশ। গোয়েন্দা সূত্রের মতে, ভয়াবহ ওই হামলার ব্লুপ্রিন্ট রচনা করা হয়েছিল ঘটনার কয়েক দিন আগে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা আদালতে বলেছেন ঘটনার নেপথ্যের নাটকীয় কাহিনী।

আদালত সূত্র জানায়, নব্য জেএমবি নামের জঙ্গিগোষ্ঠী ২০১৬ সালের  ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় বিদেশিদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। হামলার পেছনে জঙ্গিদের টার্গেট ছিল বিদেশিদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটিয়ে দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমে সাড়া ফেলে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়া।

holy artizan-killer gongi-www.jatirkhantha.com.bdগুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ঢাকার আদালতে ইতিপূর্বে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ওই জবানবন্দিতে উঠে এসেছে হত্যাযজ্ঞের অজানা ব্লুপ্রিন্ট।রাজীব জানায়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক বিদেশি নাগরিক, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, হিন্দু পুরোহিত, শিয়া অনুসারীকে হত্যা, শিয়া ও আহমদিয়া মসজিদে হামলার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি।

এরই ধারাবাহিকতায় এই জঙ্গিরা রাজধানীতে বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজারে কলেজ মোড়-সংলগ্ন এলাকায় একটি বাড়িতে তাঁরা শুরা কমিটির বৈঠক করেন।

বৈঠকে নব্য জেএমবির প্রধান সংগঠক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় বড় ধরনের হামলার প্রস্তাব করেন। তিনি জানান, বিদেশিদের ওপর আক্রমণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশে জিহাদিরা যেভাবে হামলা করে, সে ধরনের আক্রমণ করতে হবে। অন্যরা এমন হামলার সামর্থ্য ও প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চান। পরে হামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে শুরা কমিটি।holy artizan-killer gongi-www.jatirkhantha.com.bd3

শুরা বৈঠকে তামিম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শুরা সদস্য সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, শরিফুল ইসলাম খালেদ, মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন, আবু রায়হান ওরফে তারেক প্রমুখ। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, হামলার মূল সমন্বয়ক হবেন তামিম চৌধুরী। সহ-সমন্বয়ক নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। মারজান ছিলেন তামিমের ডান হাত। আনুষঙ্গিক সরবরাহের (লজিস্টিক সাপোর্ট) দায়িত্বে ছিলেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট।

শুরা কমিটি হামলার প্রস্তাব অনুমোদন করার পর হামলার জন্য পাঁচজন ইসাবা (যোদ্ধা বা আক্রমণকারী) বাছাই করার জন্য নব্য জেএমবির তখনকার সামরিক কমান্ডার শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বলা হয়, ঢাকার ছেলে লাগবে, যাঁরা গুলশান এলাকার পরিবেশ ও পথঘাটের সঙ্গে পরিচিত।

তখন নব্য জেএমবির ঢাকার সামরিক কমান্ডার ছিলেন আবু রায়হান ওরফে তারেক (পরে কল্যাণপুরের আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত)। আর উত্তরবঙ্গের কমান্ডার ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী (এখন কারাগারে)। এই দুজনকে বাছাই করা এমন কয়েকজন ইসাবা দিতে বলেন খালেদ, যাঁরা আত্মঘাতী হবেন।
ar
তারেক তিনজনের নাম দেন। তাঁরা হলেন রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম ও সামেহ মোবাশ্বের। তিনজনেরই বাসা ঢাকায়। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। আর রাজীব গান্ধী দুজনের নাম দেন। তাঁরা হলেন শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ ও খাইরুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধন। এই দুজনের বাড়ি বগুড়ায়। একজন কলেজে, অপরজন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। দুজনই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

এ ছাড়া রাজীব গান্ধী আরও একজনকে সরবরাহ করেছিলেন। তাঁর নাম শরিফুল ইসলাম ওরফে ডন, বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। শরিফুল গত বছর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলা করতে গিয়ে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন এবং পরে র‍্যাবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

holy artizan-killer gongi-www.jatirkhantha.com.bd1এই ছয়জনসহ বেশ কয়েকজন তরুণ গত বছরের জানুয়ারি থেকে কথিত হিজরতের নামে বাড়ি ছাড়েন। তাঁদের মধ্যে নিবরাস, রোহান ও সামেহ মোবাশ্বের এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলা করতে গিয়ে নিহত আবিরসহ কয়েকজন বাড়ি ছেড়ে ঝিনাইদহে জঙ্গিদের ভাড়া করা বাড়িতে ওঠেন ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে।

তাঁদের সেখানে নিয়ে যান মারজানের ভগ্নিপতি হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর। নব্য জেএমবির নেতা সাগর ওই বাড়িটি ভাড়া করেন। আর গুলশান হামলায় সরাসরি জড়িত অপর দুই জঙ্গিসহ ঘরছাড়া অনেকে বগুড়া, গাইবান্ধা, পাবনায় বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় ছিলেন।

এসব তরুণকে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় রেখে জঙ্গিবাদের বিষয়ে তাত্ত্বিক দীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। গুলশান হামলায় জড়িত পাঁচজনকে দিয়েও ওই সময় ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু পুরোহিত, ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান, শিয়াসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করানো হয়। এভাবে তাঁদের মানুষ খুনে অভ্যস্ত করা হয়।
holy artizan-killer gongi-www.jatirkhantha.com.bd2
পরে গুলশান হামলার জন্য নির্বাচিত পাঁচজনকে মারজানের কাছে পাঠান কথিত সামরিক কমান্ডার খালিদ। মারজান তাঁদের নিয়ে যান গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ফুলছড়ি চরে। সেখানে ক্যাম্প করে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ছিলেন প্রধান প্রশিক্ষক। তিনি একে-২২ রাইফেল ও পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। তারেক শেখান বোমার ব্যবহার।

রাজীব গান্ধী জবানবন্দিতে বলেছেন, ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিনি নিজে, তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে মানিক, মারজান, রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, খালেদ ও রিপন বিভিন্ন সময়ে যান। তাঁরা সাংগঠনিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁদের মধ্যে তামিম, মেজর জাহিদ, তারেক ও সারোয়ার পরে র‍্যাব-পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন। রিগ্যান কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে রাজীব গান্ধী গ্রেপ্তার হন। বাশারুজ্জামান, খালিদ ও রিপন এখনো ধরা পড়েননি।

হামলার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে নব্য জেএমবির জঙ্গি রাশেদ ওরফে রেস (তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পুলিশ এখনো পায়নি) ও সাগরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাশেদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মে মাসে চারটি পিস্তল আনেন। সেগুলো দেন ছোট মিজানকে (চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাড়ি)। তিনি আমের ঝুড়িতে করে এসব অস্ত্র ঢাকায় এনে বাশারুজ্জামানকে দেন। বাশারুজ্জামান পৌঁছে দেন মারজানের কাছে।

একইভাবে সাগর ও ছোট মিজান পাঁচটি একে-২২ রাইফেল একই সীমান্ত দিয়ে আনেন। রাইফেলগুলো আনা হয় আরও আগে। রাইফেলগুলো প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হয়। ভারত থেকে এসব অস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করেন বড় মিজান। তিনি এখন কারাগারে। হামলায় ব্যবহৃত বোমা আনেন সাগর। মে মাসে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে বোমাগুলো তৈরি অবস্থায় আনা হয়।

পরে ঢাকায় মারজানের কাছে সেগুলো পৌঁছানো হয়। পুরোনো জেএমবি থেকে নব্য জেএমবিতে আসা সোহেল মাহফুজ ওরফে নসরুল্লাহও বোমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় বলেছেন। সোহেল মাহফুজকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।

গুলশান হামলা মামলায় গ্রেপ্তার এক জঙ্গি আদালতে তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, হামলা পরিচালনার জন্য ২৮ জুন তামিম বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আনেন। বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে তামিমের হাতে দেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, তারা যে সমস্ত অস্ত্র ও বিস্ফোরক সেখানে ব্যবহার করেছে এবং অন্যান্য সামগ্রী টি-শার্ট, কেডস, ব্যাকপ্যাক সংগ্রহ করেছে, এটা একটা লো-কস্ট টেররিজম। আট-নয় লাখ টাকার বেশি তাদের খরচ হয়নি।’ তিনি বলেন, মোটামুটি সচ্ছল কিছু লোক এ দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তানভীর কাদেরি একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করতেন, তাঁর স্ত্রীও একটি বিদেশি এনজিওতে কাজ করেছেন। ঘর ছাড়ার আগে তাঁরা তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট ও গাড়ি বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন। ফলে অর্থের জন্য তাঁদের খুব বেশি বাইরের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি। কমন ফান্ড (অভিন্ন তহবিল) থেকে তাঁরা হামলার ব্যয় নির্বাহ করেছেন।

এরপর বাশারুজ্জামানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কূটনৈতিক এলাকার কাছাকাছি বসুন্ধরা এলাকায় বাসা ভাড়া করার জন্য। তিনি নব্য জেএমবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা তানভীর কাদেরিকে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর রোডের ই-ব্লকে পাঁচ কক্ষের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন। ওই বাসার ফ্রিজ ও আসবাবও কেনা হয়। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসা তানভীর পরে পুলিশের আজিমপুর অভিযানে নিহত হন।

একই সময় ১ জুন শেওড়াপাড়ায়ও একটি বাসা ভাড়া করা হয়। এটিকে জঙ্গিরা তাঁদের ভাষায় ‘কন্ট্রোল রুম’ বানান। হামলার শুরুর আগ দিয়ে তামিম ও মারজান সেখানে গিয়ে ওঠেন। এ ছাড়া পল্লবীর রূপনগরে ও নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আরও দুটি বাসা ভাড়া করা হয়।

জুনের ১ তারিখে তানভীর সপরিবারে বসুন্ধরার বাসায় ওঠেন। ৭ জুন ওই বাসায় ওঠেন বাশারুজ্জামান। পরদিন ৮ জুন পাঁচ আক্রমণকারীকে নিয়ে সেখানে ওঠেন মারজান ও তাঁর স্ত্রী। ১১ জুন আসেন তামিম চৌধুরী। তখনো হোলি আর্টিজানকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়নি।কয়েক দিন পর মারজান পাঁচটি ব্যাগ (ব্যাকপ্যাক) নিয়ে আসেন। তাতে পিস্তল, একে-২২ রাইফেল, চাপাতি ও বোমা ছিল।

১ জুলাই পর্যন্ত ওই বাসায় তাঁরা সবাই অবস্থান করেছেন। বড় একটি কক্ষে পাঁচজনকে নিয়ে তামিম সারা দিন জিকির করতেন। তাঁরা ওই কক্ষ থেকে কম বের হতেন। নামাজ পড়তেন ও খাবার খেতেন এই কক্ষে। বাকি কক্ষগুলোতে তানভীর, মারজান, বাশারুজ্জামান, রাজীব গান্ধী ও তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানেরা থাকতেন।

জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল গুলশান-বনানী এলাকা-। সিদ্ধান্ত হয়, হামলার জন্য এমন স্থান বেছে নিতে হবে, যেখানে একসঙ্গে বেশিসংখ্যক বিদেশি নাগরিক সমবেত হন ও সিসি ক্যামেরা নেই। সে অনুযায়ী, জুনের মাঝামাঝি থেকে লক্ষ্যবস্তু চূড়ান্ত করতে গুলশান এলাকার বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ রেকি শুরু করে জঙ্গিরা।পরে সুবিধা অনুযায়ী জঙ্গিরা হোলি আর্টিজানকে বাছাই করে।

জঙ্গিরা নিশ্চিত হন, হোলি আর্টিজানে অনেক বিদেশি খেতে আসেন। শুক্রবারে ভিড় আরও বাড়ে। এর নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢিলেঢালা। সেখানে সিসি ক্যামেরা আছে, তাতে কে আসা-যাওয়া করছে তা দেখা যায়, কিন্তু রেকর্ড হয় না। হোলি আর্টিজানের পেছনে লেক। হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেবল সামনের দিক থেকে মোকাবিলা করতে হবে। এসব বিবেচনা করে সবদিক থেকেই উপযুক্ত লক্ষ্যবস্তু হিসেবে জঙ্গিরা হোলি আর্টিজান বেকারিকে বেছে নেয়। ঘটনার তিন-চার দিন আগে হামলাকারী দলটিকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে হোলি আর্টিজানই হচ্ছে তাদের টার্গেট।

নিবরাস, রোহান ও মোবাশ্বের আগে থেকে এই বেকারি চিনতেন। তামিমের নির্দেশে ২৭ জুন সন্ধ্যার পর রোহান ও নিবরাসকে নিয়ে মারজান হোলি আর্টিজান রেকি করেন। পরদিন সন্ধ্যায় আবার বাশারুজ্জামান, খায়রুল ও শফিকুল রেকি করেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় তাঁরা বসুন্ধরার বাসায় ফিরে এসে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

এরপর ২৯ জুন তামিম, রোহান ও মোবাশ্বের সন্ধ্যার পর বের হন এবং হোলি আর্টিজান রেকি করেন। তাঁরা রাত ১১টায় বাসায় ফিরে আসেন। এরপর তামিম হামলাকারী দলের সবাইকে নিয়ে বসেন। রোহান ইমতিয়াজকে হামলার নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাজীব গান্ধীর জবানবন্দি অনুযায়ী, ৩০ জুন সকালে বসুন্ধরার বাসায় আসেন সারোয়ার জাহান।

সবাইকে নিয়ে তিনি বৈঠক করেন। তিনি জানান, পরদিন ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে হামলা হবে। বিকেলে সারোয়ার জাহানের ইমামতিতে সবাই আসরের নামাজ পড়েন। তারপর সারোয়ার জাহান হামলাকারী পাঁচজনের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। সারোয়ার বলেন, ‘তোমরা হোলি আর্টিজানে হামলার সময় কখনো হতাশ হবে না।

একজনের গুলি শেষ হলে আরেকজন ব্যাকআপ দেবে। মনে রাখবে, আমাদের হারানোর কিছু নেই। অপারেশনের সময় তাড়াহুড়োর দরকার নেই। খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজগুলো করবে। আর মুশরেকদের ওপর কোনো দয়া দেখাবে না। এমনকি সে যদি সাংবাদিকও হয়। সর্বদা জিকিরের মধ্যে থাকবে। যদি কেউ বন্দী হয়ে যায়, তাহলে নিজেকে নিজে শেষ করে দেবে।’ এরপর সারোয়ার চলে যান। তামিম হামলাকারী পাঁচজনের জন্য পাঁচটি টি-শার্ট ও পাঁচটি জিনসের প্যান্ট কিনতে পাঠান বাশারুজ্জামানকে।

১ জুলাই সকাল ১০টার সময় বাশারুজ্জামান বসুন্ধরার বাসায় এসে হামলাকারীদের প্রত্যেকের ব্যাগে একটি করে একে-২২, একটি পিস্তল, একটি চাপাতিসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে গুলি ঢুকিয়ে দেন। চারটি গ্রেনেড (হাতে তৈরি বোমা) নিবরাসদের দুজনের ব্যাগে দুটি করে ঢুকিয়ে দেন। এরপর বসুন্ধরার বাসায় সবাই জোহরের নামাজ পড়েন।

বেলা তিনটার দিকে তামিম সিদ্ধান্ত জানান, রাজীব গান্ধী স্ত্রী-সন্তানসহ রূপনগরের নতুন বাসায় চলে যাবেন। তারপর আসরের নামাজের পর রোহান, নিবরাস ও মোবাশ্বের অস্ত্র-গুলির ব্যাগসহ বের হয়ে যাবেন। তার এক ঘণ্টা পর অপর দুজন শফিকুল ও খাইরুল বের হবেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ হয়ে আক্রমণকারী পাঁচজন কিছু পথ রিকশায় এবং কিছু পথ হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এর পরপর বাশারুজ্জামান সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে আসেন। এতে চেপে তামিম ও মারজান একসঙ্গে বের হন। তাঁরা শেওড়াপাড়ার বাসায় ওঠেন। যাওয়ার সময় বাকিদের ইফতার সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে বলে যান।

এরপর তানভীর কাদেরি ও বাশারুজ্জামান সপরিবারে ওঠেন পল্লবীর রূপনগরের বাসায়। যেখানে আগে থেকে ছিলেন মেজর জাহিদ ও তাঁর পরিবার।ইফতারের পর জঙ্গিরা হোলি আর্টিজানে আক্রমণ করেন। তাঁরা ভেতরে থাকা সবাইকে জিম্মি করেন। এরপর দেশি-বিদেশি ২০ জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেন। ওই সময় অভিযানে গিয়ে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

তামিম ও মারজান শেওড়াপাড়ার বাসায় উঠে ইন্টারনেটে যোগাযোগের অ্যাপ থ্রিমায় হামলার খবরের অপেক্ষায় থাকেন। জঙ্গিরা হত্যাযজ্ঞ শেষ করে জিম্মিদের ফোন থেকে তামিমকে অ্যাপে মেসেজ পাঠায়। হামলাকারীরা সঙ্গে কোনো ফোন নেয়নি। হামলার পরদিন তামিম শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ভাড়া করা বাসায় চলে যান। সঙ্গে যান নব্য জেএমবির মিডিয়াপ্রধান তাওসিফ। মারজান চলে যান রূপনগরের বাসায়।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, হোলি আর্টিজানের ঘটনায় যে নিষ্ঠুরতা দেখা গেছে, তা আগে দেখা যায়নি। দেশে এতসংখ্যক বিদেশি এর আগে কখনো মারা যাননি। তিনি বলেন, এ হামলার সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত অর্থাৎ যাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই নিহত হয়েছেন। হামলার পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন, এমন আটজন গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন। গ্রেপ্তার হওয়া তিন জঙ্গি নিজেদের আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জড়িত আরও পাঁচজনকে খোঁজা হচ্ছে।