• শনিবার , ২০ এপ্রিল ২০২৪

সিয়াম সাধনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


প্রকাশিত: ২:১০ এএম, ৩০ জুন ১৪ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৯৫ বার

 

 

Ramazan-Calender-2014প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত নবী-রাসুলগণ সবাই রোজা পালন করেছেন। রোজা শুধু নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ‘আইয়ামে বিজ’-এর রোজা ফরজ ছিল। আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-এর কাছে ঐশীবাণী পাঠালেন, ‘তুমি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখো।’ হজরত আদম (আ.) এ তিনটি রোজা রাখায় তাঁর দেহের রং আবার উজ্জ্বল হলো। এ জন্য এই তিন দিনকে আইয়ামে বিজ বলা হয়ে থাকে। (গুনিয়াতুত ত্বালেবীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩০৭) বেহেশতে হজরত আদম (আ.) যখন নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেছিলেন এবং তওবা করেছিলেন, তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তাঁর তওবা কবুল হয়নি। ৩০ দিন পর তাঁর তওবা কবুল হয়। এরপর তাঁর সন্তানদের ওপরে ৩০টি রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়। (ফাতহুল বারী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১০২-১০৩)
হজরত নূহ (আ.)-কে ‘দ্বিতীয় আদম’ বলা হয়। তাঁর যুগেও সিয়াম পালন করা হয়েছিল। তাফসিরে ইবনে কাসিরে বর্ণিত আছে, হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের বিধান ছিল। তাফসিরবিদ হজরত কাতাদা (র.) বলেন, মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। মুসলিম মিল্লাতের পিতা সহিফাপ্রাপ্ত নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর যুগেও সিয়াম পালন করা হয়েছিল।
আসমানি কিতাব তাওরাতপ্রাপ্ত প্রসিদ্ধ নবী হজরত মূসা (আ.)-এর যুগেও রোজার বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা অবস্থায় পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ তোমরা কিসের রোজা করছ?’ তারা বলল, ‘এটা সেই মহান দিন, যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মূসা (আ.) ও তাঁর কাওম (বনি ইসরাঈল)-কে মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। ফলে শুকরিয়াস্বরূপ হজরত মূসা (আ.) ওই দিন রোজা রেখেছিলেন, তাই আমরা আজ রোজা করছি।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের অপেক্ষা হজরত মূসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিন সাওম পালন করেন এবং সবাইকে রোজা রাখার নির্দেশ দেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাতপ্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে বর্ণিত আছে, হজরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার না করে ধ্যানে কাটিয়েছিলেন। তাই ইহুদিরা সাধারণভাবে হজরত মূসা (আ.)-এর অনুসরণে ৪০টি রোজা রাখা ভালো মনে করত। তার মধ্যে ৪০তম দিনটিতে তাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ ছিল, যা ইহুদিদের সপ্তম মাস তিসরিনের দশম তারিখে পড়ত। এ জন্য ওই দিনটিকে আশুরা বা দশম দিন বলা হয়। এ আশুরার দিনে হজরত মূসা (আ.) তাওরাতের ১০টি বিধান পেয়েছিলেন। এ কারণেই তাওরাতে ওই দিনের রোজার জন্য তাগিদ এসেছে। এ ছাড়া ইহুদি সহিফাতে অন্যান্য রোজারও সুস্পষ্ট হুকুম রয়েছে।
আসমানি কিতাব জাবুরপ্রাপ্ত বিখ্যাত নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় থাকতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ হজরত দাউদ (আ.) অর্ধেক বছর রোজা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা রোজা থাকতেন।
আসমানি কিতাব ইঞ্জিলপ্রাপ্ত বিশিষ্ট নবী হজরত ঈসা (আ.)-এর যুগে রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। হজরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী সম্প্রদায় রোজা রাখত। হজরত ঈসা (আ.) তাঁর ধর্ম প্রচার শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে জঙ্গলে ৪০ দিন সিয়াম সাধনা করেছিলেন। একদা হজরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞাসা করেন যে ‘আমরা অপবিত্র আত্মাকে কী করে বের করব?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘তা দোয়া ও রোজা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বের হতে পারে না।’ (মথি ৭-৬৬, সীরাতুন নবী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ. ২৮৭-২৮৮) খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। পবিত্র বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত লাভের আগে আরবের মুশরিকদের মধ্যেও সিয়ামের প্রচলন ছিল। যেমন আশুরার দিনে কুরাইশরা রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রাক-ইসলামি যুগে এই রোজা রাখতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন, তখন এই রোজা নিজে রাখেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে রোজা রাখার হুকুম দেন। পরিশেষে মাহে রমজানের সিয়াম যখন ফরজ হয়, তখন তিনি আশুরার রোজা ছেড়ে দেন। (বুখারি ও মুসলিম) হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) আমাদের আইয়ামে বিজের রোজা রাখার হুকুম দিতেন, আর আইয়ামে বিজের দিনগুলো হচ্ছে চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। (আবু দাউদ) রাসুলুল্লাহ (সা.) গৃহে অবস্থানকালে বা ভ্রমণরত অবস্থায় কখনো আইয়ামে বিজের রোজা ছাড়তেন না। (নাসাঈ) ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত ও ঐচ্ছিক হয়ে যায়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com