• শুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪

বিমানের ১০ সোনা চোরাচালানী কব্জায় ১২৪ কেজি সোনা পাচার


প্রকাশিত: ৭:০১ পিএম, ৬ ডিসেম্বর ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১০৮ বার

 

goldশফিক আজিজ.ঢাকা:
প্রতিদিনই সোনা চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। ধরা পড়ছে কালেভদ্রে।পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা বিভাগ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন biman-khol;;;;;;;;;;(এপিবিএন) ও শুল্ক কর্মকর্তারা বলেছেন, সোনা চোরাচালানে বিমান ও বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ সরাসরি জড়িত।

ঢাকা কাস্টম হাউসের শুল্ক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা বলেন, গত দুই বছরে এক রতি সোনা আমদানিরও শুল্ক পায়নি সরকার। তবে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত ২১০ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। ২০১২ সালে একই বিমানবন্দর থেকে পাঁচ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১১ দশমিক ৬৯ কেজি সোনা উদ্ধার করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ।

এদিকে গতকাল রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১২৪ কেজি সোনা নিয়ে আসার ঘটনায় মামলা করেছে শুল্ক বিভাগ। মামলায় বাংলাদেশ বিমানের ১০ জন কর্মীসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন ভারতের ও একজন নেপালের নাগরিক রয়েছেন। ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই বিমানবন্দরে ওই সোনা আটক করা হয়।

শুক্রবার রাতে বিমানবন্দর থানায় ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মোস্তফা জামাল বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত।

 

তাঁরা হলেন উড়োজাহাজ মেকানিক মাসুদুর রহমান, মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া, জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ, জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল হাসান, ক্লিনিং সুপারভাইজার আবু জাফর, মেকানিক মজিবর রহমান, প্রকৌশল হ্যাঙ্গারের মেকানিক ওসমান গনি, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ আহমেদ, হ্যাঙ্গারের কর্মী রায়হান ও মাকসুদ। প্রথম ছয়জন আসামি বিভিন্ন সময় সোনা পাচারের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। পরে আবার জামিনে মুক্তিও পান।

মামলার অন্য চারজন আসামি হলেন ভারতের নাগরিক জ্যাসন প্রিন্স, বাংলাদেশের জসিম, ১২৪ কেজি সোনার দাবিদার নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসান ও তাঁর বাংলাদেশি এজেন্ট মিলন সিকদার।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার কাজী মুহম্মদ জিয়া উদ্দিনের ভাষ্য, ১২৪ কেজি সোনা আটকের ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খানকে প্রধান করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশে এ মামলাটি করা হয়েছে।

গত বছরের ২৪ জুলাই দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের (এয়ারবাস) কার্গো হোল থেকে ১২৪ কেজি ওজনের এক হাজার ৬৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। শুল্ক বিভাগের হিসাবে, যার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। এ যাবৎ ধরা পড়া সোনার চালানের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় চালান।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইনামুল হক খান দৈনিক জাতিরকন্ঠকে বলেন, পুরোনো গয়না, প্রবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিলাম করলে সেখান থেকে সোনা কেনেন তাঁরা।

জুয়েলার্স সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আট থেকে ১০ হাজার গয়নার দোকানে প্রতিদিন ২৫ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়। এই পরিমাণ স্বর্ণালংকারের চাহিদা অন্যের গয়না ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলাম থেকে মেটানো সম্ভব নয়।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের অন্যান্য সোনার বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশে মূল্যের হেরফের তেমন নেই। সহজে বহন করা যায় বলেই পাচারকারীরা সোনাকে বেছে নেন। আর বাংলাদেশে খাদ মিশিয়ে গয়না তৈরি হওয়ায় লাভের পরিমাণ বেড়ে যায়।

শাহজালাল বিমানবন্দরে সোনা পাচারের ঘটনার বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তকারী সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুবাইয়ে বসবাসকারী কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি এ দেশে সোনা পাঠানোর কাজ করেন। সিঙ্গাপুর, দোহা, হংকংয়েও এই পাচারকারী চক্রের লোকজন অবস্থান করেন। মূলত এসব রুট থেকে যাত্রীকে দিয়ে টাকা অথবা বিমান টিকিটের বিনিময়ে কখনো ফুলদানির ভেতর, কখনো বা জুতার ভেতর ও কার্বন পেপারে সোনার বার এ দেশে পাচার করা হয়।

সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে অস্থায়ী ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করে থাকেন, তাঁরাই এসব সোনা উড়োজাহাজ থেকে নামানোর কাজ করেন। এরপর বোর্ডিং ব্রিজের পাশে টয়লেটে সোনা রেখে আসা হয়। আরেকটি দলের কাজ টয়লেট থেকে বিমানবন্দরের বাইরে সেগুলো নিয়ে আসা। অন্য একটি দল পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারসহ অন্যান্য স্থানে ক্রেতাদের কাছে সোনার চালান পৌঁছানোর কাজ করে থাকে। পরিশ্রমের টাকাও সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নেয় তারা।

এপিবিএনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চোরাচালানের ঘটনায় বিমানের প্রকৌশলীরা জড়িত ছিলেন বলে তিনি মনে করেন। ওই ঘটনায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ।

ওই সোনা পাওয়া গিয়েছিল গত ২৪ জুলাই নেপাল থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের ডিসি-১০ উড়োজাহাজের কার্গো হোলের একটা প্যানেল বক্সের ভেতর থেকে। তিনি বলেন, যাঁরা মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ করেন, তাঁদের পক্ষে ওই প্যানেল বক্সের ঢাকনা (শিট) খুলে রাখা সম্ভব নয়। এটি সম্ভব শুধু প্রকৌশলীদের পক্ষে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ধরাও পড়েনি জড়িত কেউ। গত ছয় মাসে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে কিংবা বন্দরের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় একাধিকবার বিপুল পরিমাণ সোনা উদ্ধার করেছে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব ঘটনায় শুধু বিভাগীয় মামলা হয়।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার জাকিয়া সুলতানা বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষ কেন এ ঘটনায় মামলা করেনি? উড়োজাহাজের কার্গো হোলের ভেতরে তো কাস্টমের কেউ যেতে পারেন না। কোনো ব্যক্তিকে আমরা শাস্তি দিতে পারি না।

বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘটনা ঘটলে তারা তদন্ত কমিটি করে। ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধারের ঘটনায় বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান আহ্বায়ক বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) এম এ মোমিন। তার দাবি তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হচ্ছে।

কাস্টম কর্মকর্তারা বলেছেন, ১২৪ কেজি সোনা পাচারের ঘটনায় বিমানের কর্মীরা অবশ্যই জড়িত রয়েছেন। ২৪ জুলাই দুপুরে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় ফেরে বিজি ৭০২ উড়োজাহাজটি। এর আগে ২৩ জুলাই রাতে উড়োজাহাজটি দুবাই বিমানবন্দর ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছায় ২৪ জুলাই সকাল আটটায়। ওই দিন সকালেই সেটি সিলেট হয়ে কাঠমান্ডু যায়। ২৪ জুলাই বেলা পৌনে দুইটার দিকে উড়োজাহাজটি ঢাকায় ফিরে আসে।

কাস্টম কর্মকর্তারা জানায়,  সোনার চালানটি বিমানের বডির ফাঁপা অংশে বিশেষভাবে ১৫টি প্যাকেটে রাখা ছিল। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের সহায়তা ছাড়া আর কারও পক্ষে এত বড় চালান সেখানে রাখা সম্ভব নয়। এ ঘটনায় বিমানের কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) এম এ মোমেনকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে।
চোরাচালান সিন্ডিকেট

গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সাড়ে ১৩ কেজি সোনাসহ মনোয়ারুল হক নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ। মনোয়ারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী দেবু ও সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত সংস্থা ডিবি। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বিমানবন্দরে কর্মরত জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মাঠ কর্মকর্তা আবদুল আজিজ শাহ, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা অপারেটর রেখা পারভিন, নিরাপত্তা সুপারভাইজার আলো, নিরাপত্তারক্ষী লাভলী, মোতালেব খানসহ কয়েকজনের নাম উঠে আসে। এরপর আজিজ শাহ, সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী কবির আহমেদ, মোরশেদ আলম নামের এক চোরাকারবারি ও তাঁর গাড়িচালক হেলাল মিয়াকেও গ্রেপ্তার করে ডিবি। তবে এঁদের অনেকে এখনো পলাতক।

 ডিবি সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে একটি চক্র নগদ টাকা দুবাই ও সিঙ্গাপুরে পাঠায়। সেই টাকায় স্বর্ণ ও ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি কিনে আবার চোরাই পথেই (ঘোষণা ছাড়া) বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এর সঙ্গে মানি এক্সচেঞ্জ, স্বর্ণকার ও ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ীদেরও যোগসাজশ রয়েছে। বিমানবন্দরের ভেতরে মানি এক্সচেঞ্জের কর্মীরা নগদ টাকা তুলে দেন সিভিল এভিয়েশনের কর্মীদের হাতে। এরপর সিভিল এভিয়েশনের কর্মীরা বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় গিয়ে সুযোগ বুঝে উড়োজাহাজের নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা যাত্রীর হাতে মুদ্রার প্যাকেট তুলে দেন। এই টাকাটা আসে স্বর্ণ বা ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ীদের লগ্নি থেকে। আবার ফিরতি পথে সোনা বা ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি আনার সময় সাহায্য নেওয়া হয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীদের। যাত্রীরা বিমানবন্দরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ওই সব মালামালের প্যাকেট রেখে যান। তারপর বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা সেগুলো বিমানবন্দরের বাইরে বের করে দেন।

এ রকম মুদ্রা বহনের সময়ই গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন দেশের মুদ্রাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কামরুন্নাহার নামের এক বিমানবালা। তাঁর কাছে গ্রেপ্তারের চার দিন আগে (২৫ সেপ্টেম্বর) দুবাইয়ের আজমি জুয়েলার্স থেকে সোনার ১০টি বার কেনার রসিদ পাওয়া যায়।

তবে শাহজালালে কর্মরত এপিবিএনের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর এপিবিএনের যে কর্মকর্তা সোনার চালানটি ধরেছিলেন, তাঁকে বিমানবন্দর থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার চাপের মুখে ওই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি চোরাচালানের সঙ্গে বিমানবন্দরে কর্মরত কোনো না কোনো সংস্থার কর্মকর্তা বা সদস্যরা জড়িত থাকেন। পরে এগুলো ভালোভাবে তদন্তও করতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন ওই কর্মকর্তা।