• শুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪

জঙ্গিবাদ বিরোধী দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা


প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১২ জানুয়ারী ১৫ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৬২ বার

journalistকামাল আহমেদ : শুধু কার্টুনের জন্য যদি এভাবে জীবন দিতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পত্রিকাগুলোর চেহারা কী দাঁড়াবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্কার-এর কার্টুনিস্ট এঁকে দেখিয়েছেন। চারদিকে কালো রেখা দিয়ে তৈরি একটি চতুর্ভুজ, যার ভেতরটা খালি। ওপরে লেখা, ‘প্লিজ এনজয় দিস কালচারালি, এথনিক্যালি, রিলিজিয়াসলি অ্যান্ড পলিটিক্যালি কারেক্ট কার্টুন রেসপন্সিবলি। থ্যাংক ইউ।’ প্যারিসে ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি হেবদোর দপ্তরে দুই জঙ্গিবাদী ইসলামপন্থীর হামলায় ১০ জন কার্টুনিস্ট সাংবাদিক এবং পুলিশের দুই সদস্য নিহত হওয়ার কথা প্রচার হওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই এই কার্টুনটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে প্রকাশিত হয়। পরে বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমগুলো এই হামলার নিন্দা জানিয়ে এবং নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংহতি প্রকাশ করে নানা ধরনের এবং নতুন-পুরোনো কার্টুন প্রকাশ করে।পুরোনো কার্টুনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত যেটি, সেটিও বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও গণমাধ্যম প্রকাশ ও প্রচার করে। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকদের বক্তব্য হলো, সন্ত্রাসের মুখে তাঁরা যে ভীত নন, সেটা প্রমাণ করার জন্যই তাঁরা মহানবী (সা.)-এর কার্টুনটি পুনঃ প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি হেবদোর প্রচারসংখ্যা যেখানে ছিল ৬০ হাজার, এই নিষ্ঠুর ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর আগামী সংখ্যার জন্য এর চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ। ২০০৫ সালে ডেনিশ পত্রিকা জিল্যান্ডস-পোস্টেনে কার্টুনটি প্রথম যখন প্রকাশিত হয়, তখন বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয়, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৫০ জনের মতো মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের।
শার্লি হেবদোর অফিসের ভেতরে হামলায় কী ধরনের নিষ্ঠুরতা হয়েছে, তার আসল চিত্রটা এখনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। কিন্তু হামলাকারীরা রাজপথে যে নির্মমতা দেখিয়েছে, তার ভিডিওচিত্র বিশ্বের কোটি দর্শক দেখেছেন। আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর যে পুলিশ কর্মকর্তাকে কাছ থেকে গুলি করে খুন করা হয়েছে, সেই ব্যক্তিটি ছিলেন একজন মুসলমান, মহানবী (সা.)-এর অনুসারী। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা আহমেদ মেরাবাতের এই ছবিটিও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে, যার সঙ্গে অনেকেই আবেগপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা এই হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী ঘটনা অভিহিত করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। ‘নট ইন আওয়ার নেম’ (আমাদের নামে নয়) ব্যানার বা স্লোগান দিয়ে বলেছেন যে এসব ঘৃণ্য সন্ত্রাস মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না।
jarnalism............মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধের বিষয়টি অবিচ্ছেদ্য। স্বাধীনতা তত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, যত দূর পর্যন্ত প্রসারিত হলে তা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে না। সে কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতার তীর্থকেন্দ্র হিসেবে ইউরোপ গর্ববোধ করলেও ইহুদিধর্মের প্রতি কোনো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সেখানে সহ্য করা হয় না। শার্লি হেবদো ডিসেম্বরেই বড়দিনের সময় খ্রিষ্টধর্মের প্রাণপুরুষ যিশুকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রচ্ছদ করলেও খ্রিষ্টানপ্রধান ইউরোপে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে ওই একই পত্রিকায় কথিত ইহুদিধর্মকে অবমাননার জন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানানোয় মরিস সন নামের ৮০ বছর বয়সী এক কার্টুনিস্টকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছিল। ইহুদিধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা সমালোচনা যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে আহত করে এমন কাজ গ্রহণীয় হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
প্রশ্ন উঠছে, নিরীহ মানুষের জীবনহানির কারণ ঘটাতে পারে যে ধরনের সংবাদ বা নিবন্ধ, তা প্রকাশ করা দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে কি না। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার উসকানি বা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ বলেই বিবেচনা করা হয়। প্যারিসের এই সন্ত্রাসী হামলা এবং পরবর্তী তিন দিনের রুদ্ধশাস নাটকীয়তার খবর প্রচারে অবশ্য পাশ্চাত্যের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো মোটামুটি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে অভিবাসনবিরোধী চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো বিদ্বেষ প্রচার বা উসকানি সৃষ্টির সুযোগ খুব একটা পায়নি। তবে পুলিশের হাজার হাজার সদস্য যে কজন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে ধরার জন্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন, একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাঁদের সাক্ষাৎকার সরাসরি সম্প্রচার করেছে। দুটি আলাদা অবস্থানে থাকা দুজনের এই সাক্ষাৎকার পাওয়ার বিষয়টিও ছিল অভাবিত ও বিস্ময়কর। এই সাক্ষাৎকার দুটি থেকেই জানা যায় যে ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদা ইন ইয়েমেনের নির্দেশনায় এই হামলা পরিচালিত হয়েছে। ইসলামপন্থী জঙ্গি এই দুই গোষ্ঠী পরস্পরের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে এর আগে যে ধারণা ছিল, এই সাক্ষাৎকারে তা পুরোপুরি বদলে যায়।
তবে কিছুটা বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে যুক্তরাজ্যে। সবচেয়ে উদার ও বামপন্থী হিসেবে পরিচিত পত্রিকা দি ইনডিপেনডেন্ট-এর সম্পাদক অমল রাজন লিখেছেন, তাঁর সব ইন্দ্রিয় তাঁকে বলছে যে কার্টুনগুলো প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে তিনি এত বড় ঝুঁকি নেবেন না। যুক্তরাজ্যের মূলধারার কোনো পত্রিকাই ওই বিতর্কিত কার্টুনগুলো প্রকাশ করেনি। বৃহস্পতিবার রাতে বিবিসির অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক বিতর্কের অনুষ্ঠান ‘কোশ্চেন টাইম’-এ প্রসঙ্গটি আলোচিত হয় এবং আলোচকদের সবাই এগুলো প্রকাশের পক্ষে মতামত দেন।
ব্রিটেনের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সঞ্চালক ডেভিড ডিম্বলবি অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালার প্রযোজ্য অংশটুকু উদ্ধৃত করেন। উদ্ধৃতি অনুযায়ী বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালা বলছে, ‘ধর্মীয় প্রতীক ও ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ত সতর্কতা ও বিবেচনা প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে যেগুলো অবমাননার কারণ ঘটাতে পারে। কোনো আকার বা আঙ্গিকে নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতিনিধিত্ব ঘটানো যাবে না।’ এই নীতিমালার ইলেকট্রনিক কপির ওয়েবসংযোগও সে সময়ে টুইট করা হয়। কিন্তু এর আগেই বিবিসির রাত ১০টার সংবাদে ওই কার্টুন–সংবলিত প্রচ্ছদটি প্রদর্শিত হয়। এই অসংগতির বিষয়ে বিবিসি পরে ব্যাখ্যা দিয়ে গার্ডিয়ানকে বলেছে যে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালা হালনাগাদের কাজ চলছে এবং ‘কোশ্চেন টাইম’-এর উপস্থাপক তামাদি হয়ে যাওয়া সম্পাদকীয় নীতির উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক চাপের কারণে বিবিসি এ রকম একটি জোড়াতালির ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে এমনটি ভাবতেও কষ্ট হয়।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতার মধ্যকার পার্থক্যরেখাটা যে কত সূক্ষ্ম, আমরা এখন তার একটা জটিল পরীক্ষার মুখোমুখি। প্রযুক্তির কারণে গণমাধ্যমের কোনো কিছুই এখন আর কোনো সীমানার মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব নয়। সংবাদপত্র এখন আর কোনো একটি দেশের মধ্যে ছাপা কাগজে বিতরণের ওপর নির্ভরশীল নয়, মুহূর্তের মধ্যেই অনলাইনে তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের সব প্রান্তে। কর্তৃত্ববাদী অল্প কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এখন প্রায় সর্বব্যাপী। ১০ বছর আগে যে কার্টুনটি ইউরোপের একটি দেশের একটি ভাষার সাপ্তাহিক কাগজে ছাপার কারণে বিশ্বের অন্য প্রান্তে দুই শরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে, সেই কার্টুনটিই এখন কয়েকজন সন্ত্রাসীর কাণ্ডজ্ঞানহীন অপরাধের পর নানা প্রান্তের নানা দেশে বহু ভাষার প্রকাশনায় প্রকাশিত হচ্ছে।
ফেসবুক ও টুইটার এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার দিগন্তকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করেছে। শার্লি হেবদোয় হামলার পর ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ লিখেছেন যে ফেসবুক থেকে ওই কার্টুন সরাতে রাজি না হওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি দাবি করেছেন যে তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। অবশ্য তিনি একই বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন যে ফেসবুক বিভিন্ন দেশে সেখানকার স্থানীয় আইন মেনে চলে। অর্থাৎ যেসব দেশে ধর্ম অবমাননার আইন আছে, সেসব দেশে আপত্তিকর কোনো বিষয় ফেসবুকে পাওয়া না গেলেও অন্যান্য দেশে তা পাওয়া যাবে। এই বাস্তবতায় মুসলমানদের কোনো কোনো অংশ আহত বোধ করার চ্যালেঞ্জ যে তৈরি হবে, সেটা অপ্রত্যাশিত নয়। ফলে মূলধারার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দায়িত্বশীল সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে ধর্ম অবমাননা এড়িয়ে চলার যে কৌশল অনুসরণ করে চলছিল, তার কার্যকারিতা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
২০১১ সালে ব্রেইভিক নামে নরওয়ের এক উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান তরুণ নৃশংসভাবে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল কিশোর-কিশোরী। সে একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রের কথাও জানিয়েছিল, যা ছিল চরম ইসলামবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী। ইউরোপজুড়ে এই ইসলামবিদ্বেষী বর্ণবাদী রাজনীতির উত্থানের এক অভূতপূর্ব আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুইডেনের মতো শান্তিপ্রিয় দেশে যা আগে কখনো দেখা যায়নি, তা-ই ঘটছে। স্টকহোমে সম্প্রতি কয়েকটি মসজিদে হামলা হয়েছে, যার মধ্যে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও আছে।
জার্মানিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে মুসলমান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। ব্রিটেনেও নতুন প্রাণ পাওয়া ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তি ইউকিপ নেতা ব্রিটেনের বহুজাতিক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের বিরোধিতায় দিন দিন আরও সোচ্চার হচ্ছেন। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি যাঁকে মিডিয়া মোগল বলে অভিহিত করা হয়, সেই রুপার্ট মারডক শনিবার টুইটারে মন্তব্য করেছেন, ‘ফ্রান্সের এই হামলার দায় অবশ্যই মুসলমানদের বহন করতে হবে।’ গণমাধ্যমজগতের প্রতাপশালী এই ব্যক্তির এই মন্তব্য যে বিশ্বে জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণাকে উসকে দেবে, সন্দেহ নেই। এ ধরনের বিপজ্জনক রাজনৈতিক মেরুকরণ সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আরও কোণঠাসা ও সমাজবিচ্ছিন্ন করে ফেলবে কি না, সেই দুশ্চিন্তাই এখন উদারপন্থী ও প্রগতিবাদীদের ভাবিয়ে তুলেছে।কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।