• শুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪

‘কুত্তে কে বাচ্চে কা বড়া ভাই’


প্রকাশিত: ৪:৩৭ পিএম, ৫ এপ্রিল ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৯৩ বার

ভারতে এই মুহূর্তে ভাষা-সন্ত্রাস চলছে। রাজনৈতিক পালাবদল অথবা নির্বাচনের দিনগুলোতে সব সময় এমনটা হয়ে থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
শুরুতেই এক-দুই-তিন-চার করে টাটকা-তাজা কয়েকটা নমুনা তুলে দেওয়া যাক। উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির বড় নেতা রাজ্যের মন্ত্রী আজম খান রামপুরের জনসভায় বললেন, বিজেপির প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রত্যাশী নরেন্দ্র মোদি হলেন ‘কুত্তে কে বাচ্চে কা বড়া ভাই’। হঠাৎ তাঁকে কুকুরের বড় ভাই বলার কারণ, তৃতীয়বার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মোদির চোখে যখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটা চরকি-ঘোরা ঘুরছিল, সেই সময় গোধরাকাণ্ডের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, ‘ধরুন, আমি গাড়ি চেপে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার গাড়ির চাকায় কুকুরের বাচ্চা চাপা পড়ল। তা হলেও কষ্ট তো হবে।’ মোদি বাক্যটা শেষ করেননি। ফলে সে এক তুমুল হইচই। বলাবলি শুরু হলো, গুজরাটের দাঙ্গাপীড়িত মুসলমানদের মোদি কুকুরের বাচ্চা বলেছেন। আজম খান এবার তারই মোক্ষম শোধ তুললেন ও বললেন, ‘গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মোদি বা রাজনাথ সিংয়ের দুঃখ প্রকাশের আর কোনো প্রয়োজন নেই।’
আজম খান যে দলের নেতা, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেনিপ্রসাদ ভার্মা একটা সময় সেই দলেরই সদস্য ছিলেন। ভোট-প্রচারে বেরিয়ে দিন কয়েক আগে তিনি বললেন, ‘মোদি হলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সবচেয়ে বড় গুন্ডা। রাজনাথ সিং বিজেপির সভাপতি হতে পারেন, তবে তিনি মোদির চাকর।’
দক্ষিণ দিল্লির বিজেপির প্রার্থী রমেশ বিধুরিও কম যান না। মোদি-মাহাত্ম্য প্রচারে তিনি বললেন, ওঁকে প্রধানমন্ত্রী করা খুবই জরুরি। কারণ, পিএম হয়ে উনি শুধু পাকিস্তানকেই নয়, আমেরিকাকেও ‘ঠোক দেঙ্গে’। এমনিতে ‘ঠোকা’ শব্দ নিয়ে বাঙালির আপত্তির কারণ না থাকারই কথা। কিন্তু ভরা জনসভায় হিন্দিতে ‘ঠোক দেঙ্গে’ বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত মুঠো করে প্রচলিত ভঙ্গি দেখানোর ফলে শব্দটি অসংসদীয়র পাশাপাশি অশালীনও হয়ে ওঠে। এ নিয়ে শোরগোল উঠতে বিধুরি বিনয়ের অবতার সেজে বললেন, ‘ঠোক দেঙ্গে মানে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথাই আমি বলেছি।’
সোনিয়া গান্ধী কিছুকাল আগে গুজরাটে গিয়ে মোদিকে ‘মৌত কা সওদাগর’ বলেছিলেন। এবার প্রচারের প্রথম দিকে তাঁকে ‘জহের কি খেতি’ বা বিষের খেত-এর সঙ্গে তুলনা করলেন। সোনিয়ার কথার রেশ টেনেই কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বললেন, মোদি হলেন ‘দেশের বিষ’। ওঁর আস্তিনের নিচে লুকোনো রয়েছে একটা ধারালো ছুরি। লোকটা সারাক্ষণ মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই।
ভোট-পর্ব শুরু হওয়া ইস্তক দেশজুড়ে ফি দিন এই-ই চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিশেষণের জন্ম হচ্ছে, ভাষা-সন্ত্রাসে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রাদেশিক ও জাতীয় স্তরের নেতা-নেত্রীরা। কেউ কারও চেয়ে কম নন। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিদিন জমা পড়ছে একাধিক অভিযোগ। কমিশন গন্ডা গন্ডা শোকজ নোটিশ পাঠাচ্ছে। অভিযুক্তরা জবাবও দিচ্ছেন। কেউ দুঃখ প্রকাশ করছেন, কেউ তা না করে কমিশনকে ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন, কিন্তু অকথা-কুকথায় আগল পড়ছে না। উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের কংগ্রেস প্রার্থী ইমরান মাসুদ কোনো একসময় মোদিকে ‘কুচি কুচি করে কেটে ফেলার’ কথা বলেছিলেন। সেই ভিডিও পুরোনো না নতুন বিচার না করেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়া মাত্র উত্তর প্রদেশের পুলিশ ঝটপট ইমরানকে গ্রেপ্তার করে। আদালত তাঁকে ১৪ দিনের জেল হেফাজত দেন। দিন তিনেক আগে ইমরান জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
একই ধরনের অভিযোগ একাধিকবার জমা পড়লেও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বীরভূম জেলার তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত নেয়নি। একে দিদির রাজ্য, তায় দিদি আবার মুখ্যমন্ত্রী কাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজ্যের পুলিশরাও কেউ দশানন রাবণ নয় যে একটা মাথা কাটলে বাকি নটা থাকবে। পিতৃদত্ত নামমাত্র মাথা বাঁচাতে তারা তাই দিদিরই কৃপাপ্রার্থী। ফলে অনুব্রত কী বলল না বলল, পুলিশের তা কানে তুলতে ভারি বয়ে গেছে। সে যখন বলে, সিপিএমকে জ্বালিয়ে দাও, তখন সিপিএম করা লোকেরা সত্যিই প্রমাদ গোনে। সাগর দত্ত নামে তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর একজন তো খুনই হয়ে গেল। নিহতের বাড়ির লোকজন অনুব্রতর বিরুদ্ধে এফআইআরও করল। অনুব্রত কিন্তু দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বেড়াবে না-ই বা কেন? দিদি তো বলেই দিয়েছেন, অনুব্রত ভালো সংগঠক। মাঝেমধ্যে শুধু একটু-আধটু ভুল করে ফেলে। সেটা ওর দোষ নয়। ওর ব্রেইনে অক্সিজেন কম যায়!
অনুব্রত লাই পেলে অন্যরাই বা কেন চুপ থাকবেন? মালদহের রূপকার বরকত গনি খান চৌধুরীর আঙুল ধরে রাজনীতিতে আসা সাবিত্রী মিত্র কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি বললেন, বরকতদাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাঁর পরিবারের যে দুজন সাংসদ হয়েছেন, তাঁরা কচ্ছপের মতো সারাক্ষণ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। শুধু ভোট এলে ওঁদের হাত-পা দেখা যায়।
অনুব্রতরা বুনো ওল হলে সিপিএমের সাবেক মন্ত্রী আনিসুর রহমান বাঘা তেঁতুল। তাঁর লক্ষ্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী। মমতা সম্পর্কে তিনি বললেন, উনি তো সব রং পাল্টে দিচ্ছেন। লাল রং ওঁর অসহ্য। লাল দেখলেই হয় সবুজ করে দিচ্ছেন, নতুবা নীল-সাদা। উনি বিয়েই করলেন না লাল সিঁদুর পরতে হবে বলে। সিঁদুর তো আর সবুজ হয় না!
এঁদের কারও কোনো শাস্তি হয়নি। অথচ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানানো হয়েছিল। কমিশন তাঁদের ভাষা প্রয়োগে সতর্ক থাকার উপদেশ শুনিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে শুধু।
ভোটের সময় প্রতিপক্ষকে কমবেশি কটূক্তি ৪০-৫০ বছর আগেও করা হতো। কিন্তু সেই তরজায় একটা মজা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের দেয়ালে ভোটের সময় ছড়ার প্রতিযোগিতাও দেখা যেত। ১৯৭১ সালে কংগ্রেস-সিপিআই জোটের বিরুদ্ধে সিপিএম লিখেছিল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ তখন কংগ্রেসের প্রতীক ছিল গাই-বাছুর। অবশ্য শালীনতার সীমাও যে কেউ কেউ টপকাত না, তা নয়। যেমন অকৃতদার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নলিন সরকারকে কটাক্ষ করে কমিউনিস্টদের দেয়াললিখন ছিল, ‘বাংলার মসনদে নলিন-বিধান, বাংলার কুলবধূ হও সাবধান।’ ১৯৭২ সালের ভোটের আগে কংগ্রেসিরা জ্যোতি বসুকে ব্যঙ্গ করল। টিয়া পাখির শরীরে জ্যোতি বসুর মুখ, মাথায় টোপর। ছবির নিচে লেখা, ‘বন থেকে বেরোলো টিয়ে, শোলার টোপর মাথায় দিয়ে, আবার জ্যোতি করবে বিয়ে’। সিপিএমও কম যেত না। ছবির নিচে তারা লিখল, ‘ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস, ইন্দিরাকে সাজিয়ে রাখিস’। সেই সব ব্যঙ্গ, সেই সব তির্যক বিদ্রূপের জায়গায় আজ হিংসা ও কদর্যতার রমরমা। অনুব্রত মণ্ডল তাই বলতে পারেন, ‘সিপিএম হলো ইঁদুরের জাত। ইঁদুর মারতে গর্তে বিষ দেন যেমন, তেমনভাবে সিপিএমকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলুন।’
কতটা কী করতে পারে নির্বাচন কমিশন? কমিশনের এক সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের আওতায় যে বিধান আছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি। যেমন কারও মানহানি হলে অথবা সম্প্রীতি নষ্ট কিংবা সহিংসতা ছড়ানোর প্ররোচনার অভিযোগ পেলে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা যায়। সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধেও কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু আইনের আওতায় যা নেই তেমন কোনো নির্দেশ আমরা দিতে পারি না। যেমন, এই ধরনের অভিযোগে কারও প্রার্থী পদ বাতিল করতে কমিশন পারে না।’ সূত্রটি বলেন, নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন এ ধরনের কিছু অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তাঁকে বলেছিলেন, এমন নির্দেশ কেন দেন, যা প্রচলিত আইনের আওতায় পড়ে না?
অর্থাৎ, ভাষা-সন্ত্রাসে রাশ টানতে হলে হয় মানুষের ভাষা বা রুচির বদল ঘটাতে হবে, নয়তো পাল্টাতে হবে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও জনপ্রতিনিধিত্ব আইনকে। নচেৎ, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। চলবেও।

 

 

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়