• শুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪

এনআরবি ফারমার্স ব্যাংকে লালবাত্তি’ দশা


প্রকাশিত: ৮:২৯ পিএম, ২৯ অক্টোবর ১৭ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৮ বার

এস রহমান :  এনআরবি ও ফারমার্স ব্যাংকে লালবাত্তি’র জলার অবস্থা নিয়ে তোলপাড় চলছে।এনিয়ে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। খোঁজ নিয়ে fbl_nrbc-www.jatirkhantha.com.bd----জানা গেছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। আর দায় পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দুটি ব্যাংকের বিরুদ্ধেই রয়েছে জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের বিস্তর অভিযোগ।

এ অবস্থায় সংসদীয় কমিটি ব্যাংক দুটির বিরুদ্ধে আগামী দুই মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে। রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক অনলাইন দৈনিক জাতিরকন্ঠকে একথা জানান।

সূত্র জানায়, নতুন আসা দুই ব্যাংক; এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি। তারা ব্যাংক দুটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে।  সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে,  বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এই ব্যাংকটি সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে অর্থ নিয়ে চলছে। এর ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে করে আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে বলেও মনে করছে মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ফারমার্স ব্যাংক নতুন ঋণও দিয়েছে। এসব অনিয়মের কথা স্বীকারও করেছে ব্যাংকটি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফারমার্স ব্যাংক ২০১৩ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ নিয়মাচার পরিপালন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিলতা দেখা দেয়। নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে।

অস্তিত্ববিহীন ও সাইন বোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এছাড়া ঋণ নিয়মাচার লংঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দিয়েছে। অপর্যাপ্ত ও ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে। এক ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দিয়েছে।

২০১৩ সালে জুন মাসে লাইসেন্স পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক ৩৮টি শাখা নিয়ে কাজ চালাচ্ছে। তখন আরও আটটি ব্যাংক লাইসেন্স পায়, যা রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন আলমগীর। এর আগে তার স্ত্রী ছিলেন এই পদে। শত শত কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়ম ধরা পড়ায় ২০১৬ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছর যাবৎ ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা  (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৭ তারিখে ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই।

নতুন ঋণ মঞ্জুরি ও ঋণসীমা বাড়ানোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফারমার্স ব্যাংক তা না মেনে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়,  জুন, ২০১৭ ত্রৈমাসিকে ঋণ প্রবৃদ্ধি আমানত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় ঋণ-আমানত হার দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ গ্রহণযোগী সীমার ৮৫ শতাংশ অপেক্ষা বেশি।

ব্যাংকটির ওপর দণ্ডসুদ ও জরিমানার পরিমাণ গত এক বছরে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি শাখাই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে।সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করেছে পড়লেই গা শিউরে ওঠে। এসব অনিয়মের দায় বোর্ডকে নিতে হবে। তারা দায় এড়াবে কীভাবে।’

প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো পায়ই।’কমিটির সভাপতি আরও বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংক হলেও এখানে পাবলিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের টাকায় চলে। সেজন্য কমিটি এ বিষয়ে আলোচনা করেছে।’এদিকে আজ রবিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একেএম শামীম উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে সভাপতি বলেন, ‘তিনি বলেছেন, এমডি হিসেবে তার আসার আগে আগে এগুলো হয়েছে। তারা সংশোধনের চেষ্টা করছেন।’

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী করা হয়েছে। নিয়ম ভেঙে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন আনায় অনিয়ম, অনিবাসীদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়া এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির সঙ্গে পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনের বিধান এবং ব্যাংকের আর্টিক্যালস অব অ্যসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লংঘন করে ব্যাংকের একজন পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এছাড়া নিয়ম না মেনে ৬ জন পরিচালকের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ ও ৩ জন পরিচালককে অপসারণ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ডিসেম্বর ২০১৬ প্রান্তিকে প্রায় ১৯ কোটি ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু জুন ২০১৭ প্রান্তিকে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। নতুন স্থাপিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণের হারের বিবেচনায় ব্যাংকটির অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফারমার্স ব্যাংক রয়েছে প্রথম অবস্থানে।

বৈঠকে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা দেখেছি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক এগ্রেসিভ লোন দিচ্ছে। এ বিষয়টি আমরা সতর্ক করেছি।’এদিকে সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম এবং দুর্নীতি সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।

বৈঠকে জানানো হয়, এবি ব্যাংকের যোগসাজশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়ার বিষয়ে বাংলদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ৪টি বিদেশি ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটকে তথ্য দেয়ার অনুরোধ করেছে, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী বৈঠকে কমিটিকে জানানো হবে।

ড. আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, নাজমুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, শওকত চৌধুরী এবং আখতার জাহানসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেন।