• বৃহস্পতিবার , ২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিশুদের সুরক্ষায়-সাম্যের পৃথিবীর জন্য রাগের শক্তি প্রয়োজন


প্রকাশিত: ৩:১৬ এএম, ৭ জুন ১৫ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫৫ বার

kkkkkkkkkkkkkkkkkকৈলাশ সত্যার্থী:

৩০ মে থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘দক্ষিণ এশিয়া খাদ্য অধিকার সম্মেলন ২০১৫’ উপলক্ষে বাংলাদেশ সফর করেন নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী। তিনি ১৯৫৪ সালের ১১ জানুয়ারি ভারতের মধ্যপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী কৈলাস ১৯৮৩ সাল থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে ‘শৈশব বাঁচাও আন্দোলন’ শুরু করেন। ২০১৫ সালের মার্চে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে অনুষ্ঠিত টেড সম্মেলনে তিনি এই বক্তব্য দেন।

বন্ধুরা, আজকে আমি রাগ নিয়ে কথা বলতে চাই। আমার যখন ১১ বছর বয়স, তখন আমার কিছু বন্ধু দূরে চলে যায়। বন্ধুদের বাবা-মা তাদের বইপত্র কিনে দিতে পারতেন না দেখে তারা স্কুল ছেড়ে দেয়। এই ঘটনায় আমি ভীষণ রাগ করেছিলাম। আবার, আমার বয়স যখন ২৭, তখন এক হতভাগ্য বাবার গল্প শুনেছিলাম। সেই বাবা তাঁর কন্যাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, যে ঘটনা আমাকে অনেক রাগিয়েছিল।

বন্ধুরা, শতাব্দীকাল ধরে আমাদের শেখানো হয় রাগ খুব নেতিবাচক গুণ। আমাদের মা-বাবা, শিক্ষক, ধর্মযাজকেরা সবাই কীভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাই আমাদের শেখান। এখানেই আমার প্রশ্ন, কেন রাগ নিয়ন্ত্রণ করব? আমরা কেন সমাজের মঙ্গলের জন্য আমাদের রাগকে ভালো গুণ হিসেবে দেখতে পারি না? আমরা কেন পৃথিবীর সব অমঙ্গলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সময় সমস্ত রাগ ঢেলে দিতে পারি না? বন্ধুরা, আমার সবচেয়ে আলোকিত চিন্তার জন্ম হয়েছিল এই রাগ থেকেই।
ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম মহাত্মা গান্ধীজির বড় ভক্ত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ছিলেন নেতা। তিনি আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে আমরা সমাজের নিম্নশ্রেণির ও অধিকারহীন মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে পারি। ১৯৬৯ সালে সারা ভারত যখন মহাত্মার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছিল, তখন আমার বয়স ছিল ১৫। আমি তাঁর জন্মদিন ভিন্নভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিই। ভারতে উচ্চবর্ণের মানুষের ঘরে কিংবা দোকানে নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি একটি নতুন উদাহরণ তৈরির চেষ্টা করি। নিম্নবর্ণের মানুষের রান্না খাবার উচ্চ জাতের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি সেদিন সবাইকে বলেছিলাম, ‘বড় বড় রাজনীতিবিদ এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমরা যদি সামনে না আসি, তাহলে এই প্রথা দূর হবে না। চলুন, আমরা উদাহরণ তৈরি করি।’ অবাক হয়ে দেখেছিলাম, সেই অনুষ্ঠানে কোনো রাজনৈতিক নেতাই সেদিন হাজির হননি। সেই ঘটনা আমাকে অনেক রাগিয়ে দেয়। সেদিন আমি খুব কষ্টে চোখে পানি আটকানোর চেষ্টা করছিলাম। সেই সময় আমার কাঁধে আমি একটি হাতের স্পর্শ পেয়েছিলাম। একজন অস্পৃশ্য জাতের নারী আমার ঘাড়ে হাত রেখেছিলেন। তিনি কৃতজ্ঞ চোখে আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘কৈলাশ, তুমি কেন কাঁদছ? তুমি তো আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। তুমি অস্পৃশ্য মানুষের রান্না করা খাবার মুখে তুলে নিয়েছ। এমন ঘটনা আমি আগে দেখিনি।’ সেই নারী আমাকে বলেছিলেন, ‘আজ তোমারই জয় হয়েছে।’
সেই রাতে বাড়ি ফেরার পরে আমার অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। উচ্চ জাতের মানুষেরা আমাকে শাস্তি দেয়। শাস্তি হিসেবে আমাকে ৬০০ মাইল দূরের গঙ্গা নদীতে পাপমুক্তির জন্য স্নান করার আদেশ দেওয়া হয়। ১০১ জন পুরোহিতের পা ধোয়া পানি খেতে আদেশ করা হয়। আমি ভীষণ রেগে শাস্তি নিতে অস্বীকার করি। তারা কেন আমাকে শাস্তি দেবে? আমাকে সমাজচ্যুত করার জন্য ভীষণ রাগ করেছিলাম সেদিন। আমি রেগে বর্ণপ্রথাকে সমাজ থেকে পুরোপুরি নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই সিদ্ধান্তে আমি নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেই। পারিবারিক পদবি বদলে ফেলি। আমি নিজেকে নতুন নাম দিই—সত্যার্থী; যার অর্থ সত্যানুসন্ধানী। সেটাই ছিল আমার রাগকে পরিবর্তন করার প্রথম শুরু।

কেন রাগ নিয়ন্ত্রণ করব? আমরা কেন সমাজের মঙ্গলের জন্য আমাদের রাগকে ভালো গুণ হিসেবে দেখতে পারি না? আমরা কেন পৃথিবীর সব অমঙ্গলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সময় সমস্ত রাগ ঢেলে দিতে পারি না?

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করার আগে আমি এক প্রকৌশলী ছিলাম, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কীভাবে জ্বালানি, কয়লা আর নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন হয়, তা-ই আমি শিখেছিলাম। কীভাবে নদীর স্রোত, বাতাসে প্রবাহকে আলোতে পরিণত হয়ে হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো যায়, তা-ই আমি শিখেছিলাম।
একবার ডজনের বেশি শিশুকে পাচার হতে দেখে আমি পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। পুলিশ আমাকে সাহায্য করার বদলে আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। সেই রাতে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় রাগ করেছিলাম। আমি ভাবছিলাম, যদি ১০ জন শিশুকে মুক্ত করা না হয় তাহলে আরও ৫০ জন দাসত্বে আটকা পড়বে। এভাবে চলতে পারে না। আমার বিশ্বাস জন্মে যদি যারা শিশুদের ব্যবহার করে তাদের বোঝাতে পারি, তাহলেই এই সমস্যা দূর হবে। সেই রাতের ধারণা থেকে কাজ শুরু করি। সেই প্রথম সারা বিশ্বে প্রথমবারের মতো যারা শিশুদের শ্রমিক আর দাস হিসেবে ব্যবহার করে তাদের শিক্ষিত আর সচেতন করার চেষ্টা করা শুরু করি। ইউরোপ আর আমেরিকায় আমরা সাফল্য লাভ করি। যার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ৮০ শতাংশ শিশুশ্রম কমে যায়। আমরা সব শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহারে ভোক্তা পর্যায় থেকে আন্দোলন শুরু করি। সেই আন্দোলন এখন বড় থেকে বড় হচ্ছে।
২৭ বছরে কন্যা বিক্রির ঘটনায় আমি শিশুদের দাসপ্রথা থেকে মুক্তির নতুন উপায় খুঁজি। আমরা একজন বা ১০ জন বা ২০ জন শিশুকে মুক্ত করিনি, এখন পর্যন্ত আমরা ৮৩ হাজার শিশুকে দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করেছি। সারা বিশ্বে এই আন্দোলন বড় আকারে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে।
আমার জীবনের প্রতিটি ঘটনার শুরু ছিল রাগ থেকে। রাগকে আমি ধারণায় বদলে নিয়ে কাজে নেমে পড়ি। রাগই শক্তি, রাগই জ্বালানি। প্রকৃতির নিয়মে শক্তিকে নতুন করে সৃিষ্ট করা যায় না, অদৃশ্য করা যায় না কিংবা ধ্বংস করা যায় না। তো আমরা কেন রাগের শক্তিতে সুন্দর পৃথিবীর জন্য বদলে দিতে ব্যবহার করতে পারব না? সাম্যের পৃথিবীর জন্য রাগের শক্তি প্রয়োজন।
সবাইকে ধন্যবাদ।